কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক), যে সংস্থাটি মূলত উন্নয়ন, শৃঙ্খলা ও নগর পরিকল্পনার জন্য গঠিত, সেটি এখন স্থানীয়দের চোখে হয়ে উঠেছে ভয় ও ভোগান্তির প্রতীক। একের পর এক অভিযোগ উঠছে স্বেচ্ছাচারিতা, ঘুষবাণিজ্য, রাস্তা দখল ও নোটিসবিহীন উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে। যেখানে সংস্থাটির হওয়ার কথা ছিল সাধারণ মানুষের সহযোগী, সেখানে তারা ‘স্বেচ্ছাচারী’ ও ‘স্বৈরাচারী’ আচরণ শুরু করেছে।
সংস্থাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা কখনো আইন উপেক্ষা করে, কখনো আইনের দোহাই দিয়ে চলাচলের রাস্তা দখল, নোটিস ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর এবং ঘুষ না দিলে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। বড় অননুমোদিত দালান থাকলেও নজর দেয় না কউক; কিন্তু পর্যটকদের জন্য তৈরি রেস্টুরেন্ট ও ইকো-রিসোর্ট গুঁড়িয়ে দেয়।
কউকে দীর্ঘদিন ধরে ‘সিন্ডিকেট’ সক্রিয় থাকার অভিযোগ স্থানীয়দের। বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন সিন্ডিকেট গঠনের কথাও উঠেছে। মাঠপর্যায়ে এ সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রণে আছেন অথরাইজড অফিসার রিশাদ উন-নবী—এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক সেবাপ্রার্থী। তাদের দাবি, কউকে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল অগ্রসর হয় না। অফিসে নয়, বরং রড বা সিমেন্টের দোকানে ঘুষ লেনদেনের ব্যবস্থা করা হয়। রিশাদ দুবার বদলি আদেশ পেলেও বহাল তবিয়তে কউকে রয়ে গেছেন। কউক চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিনের সবচেয়ে কাছের মানুষ তিনি। কউক কোনো অভিযানে গেলে রিশাদ ছাড়া আর কারো ফোন ধরেন না চেয়ারম্যান।
জানা গেছে, কয়েক মাস আগে সড়ক দখল করে দেয়াল তুলে দেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে আবাসিক হোটেল ‘জামান সী হাইটস’। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে হোটেল বন্ধ রয়েছে, কমপক্ষে ৬৫ জন কর্মচারী কর্মহীন।
হোটেল মালিক শাহজাহান আনসারীর অভিযোগ, কউকের রিশাদ উন-নবী ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। টাকা না দেওয়ায় রাস্তা দখল করে দেয়াল তোলা হয়। আনসারীর দাবি, রিশাদ তাকে প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আপনার বিল্ডিং ও সড়ক ভাঙার জন্য ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আমার বদলি ঠেকিয়েছি!
হোটেল জামান সী হাইটস কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, গণপূর্তের নিয়ন্ত্রণাধীন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ১৫/বি ও ১৬ নাম্বার প্লট দুটি বরাদ্দ নিয়ে মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান বাবু ও শাহজাহান আনসারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন নিয়ে আটতলা ভবন তৈরি করে ‘জামান সী হাইটস’ নামের আবাসিক হোটেলটি গড়ে তোলেন। এর জন্য ১৫ ফুট প্রস্থ ও ৪০ ফুট লম্বা সড়কও বরাদ্দ ছিল। পরে ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সেখানে ১৫ ফুট প্রস্থ ও ১৫০ ফুট দীর্ঘ চলাচলের রাস্তার অনুমোদন দেয়।
২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর কউক গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে সড়কটির দক্ষিণ পাশের ৫৫ শতক একটি জমি ইজারা নেয়। জমিটির পশ্চিম পাশে ১২৩ ফুট লম্বা মুখসহ ৫৫ শতক জমিটিতে একটি বড় কাঁচা বাজার ছিল। অভিযান চালিয়ে সেই বাজারটি উচ্ছেদ করে দখলে নেয় তারা।
দখল নেওয়া সেই বাজারের উত্তর পাশেই ১৫ ফুট প্রস্থ ও ১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের সড়কটির অবস্থান। বাজারটি দখল নেওয়ার পর কোনো ধরনের নোটিস না দিয়েই কউক সড়কটিও দখল করে নেয় এবং সড়কটির দুই মাথায় দেয়াল তুলে দেয়। এতে হোটেলটি বন্ধ হয়ে যায়। হোটেল মালিক শাহজাহান আনসারী জানান, প্রথমে সড়কটি ৪০ ফুট থাকলেও পরে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আবেদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিয়ে ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর ১৫০ ফুট দীর্ঘ সড়কটি ইজারা নেওয়া হয়। কিন্তু আইনের তোয়াক্কা না করে ‘স্বৈরাচারী’ কায়দায় সড়কটি দখল করে নেয় কউক।
তিনি বলেন, কউক ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল হোটেল সী হাইটসের নকশা জমা দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল। চিঠি পাওয়ার দুদিনের মাথায় নকশাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। সবকিছু দেওয়ার পরও অথরাইজড অফিসার রিশাদ তার কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন। সেই টাকা না দেওয়ায় জোরজবরদস্তি সড়কটি দখল করে নেওয়া হয়।
আনসারীর অভিযোগ, সড়কটি দখল নেওয়ার পর কউককে একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে সড়কটি খুলে দেওয়ার আবেদন করা হয়। কিন্তু কোনো চিঠিই আমলে নেয়নি কউক। দেখা করতে চাইলে সেই সুযোগও দেননি কউক চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন।
পরে হোটেল মালিকরা বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। একই সঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন। সূত্র মতে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বিষয়টি খোঁজ নেওয়ার জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বেসরকারি সদস্য রকিয়ত উল্লাহকে দায়িত্ব দেন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে কউক চেয়ারম্যান ও সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং)-এর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা অন্য কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে শাহজাহান আনসারীর কাগজপত্র সব ‘ফেক’ বলে জানিয়েছেন। আমি আর কথা বাড়াইনি। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি।
একটি সূত্র জানায়, রকিয়ত উল্লাহ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে জানানোর আগেই কউক চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন ও সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নাঈম মো. তালাত সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে ছুটে যান। তারা আদালতে চলমান রিটের বিষয়টি গোপন করে দাবি করেছে, কউক মামলায় জয়ী হয়ে জমির দখল নিয়েছে। তবে গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে এসব দাবি খণ্ডিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ অক্টোবরের এক চিঠিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কউক গণপূর্তের বরাদ্দকৃত প্লটের সড়ক অবৈধভাবে দখল করেছে এবং জরুরি ভিত্তিতে তা অবমুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের আরেক চিঠিতে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার গণপূর্তের বরাদ্দকৃত প্লট ৪৫/বি আংশিক, ৪৬/বি আংশিক ও ৪৬/সি আংশিকের ওপর নির্মিত ১০ নম্বর ভবনের পশ্চিম পাশের দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকের চলাচলের রাস্তাটিও দখল করে নিয়েছে কউক।
চট্টগ্রাম জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহেল সরকার স্বাক্ষরিত ওই চিঠি গত ১৬ অক্টোবর কক্সবাজার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে এসব সড়ক অবমুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইকো-রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ
এদিকে গত ২৩ অক্টোবর সকালে কউকের সচিব সানজিদা বেগমের নেতৃত্বে কলাতলীর স্যান্ডি বিচ রেস্টুরেন্ট উচ্ছেদ করা হয়। রেস্টুরেন্টের মালিক আবদুর রহমান তখন ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে জানান, কোনো নোটিস ছাড়াই তার বৈধ ইকো-রেস্টুরেন্টটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে হলেও আইনগতভাবে তিনটি নোটিস দিতে হয়। সেখানে একটি নোটিসও দেওয়া হয়নি। তিনি আরো অভিযোগ করেন রেস্টুরেন্টটির কিচেনে সেদিন শতাধিক মানুষের খাবার প্রস্তুত ছিল, যা কউকের অভিযানে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা খেয়ে ফেলেছে। তিনি এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন।
অভিযান পরিচালনাকারী সচিব সানজিদা বেগম অবশ্য দাবি করেন, ইমারত নির্মাণ আইনের আওতায় অভিযান চালানো হয়েছে। তবে নোটিস দেখানোর অনুরোধে কোনো লিখিত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি।
বড় বড় অবৈধ ভবনে কউকের নীরবতা
শহরের বিতর্কিত উত্তরণ গৃহায়ন সমবায় সমিতি এলাকায় পাহাড় কেটে ও জমি দখল করে একাধিক ৭-৮ তলা ভবন নির্মিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বেলা মামলা করলেও কউক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। স্থানীয়দের প্রশ্ন, ছোট ইকো-রেস্টুরেন্ট ভাঙা যায়, কিন্তু বিশাল ভবনগুলো দেখেও দেখা যায় না কেন?
কথা বলার অনুমতি নেই রিশাদ উন-নবীর
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের ‘আতঙ্ক’ হলেন অথরাইজড অফিসার মোহাম্মদ রিশাদ উন-নবী। তাকে ঘুষ না দিয়ে কউক থেকে কেউ কাজ আদায় করতে পেরেছেন এমন নজির নেই। তাকে টাকা দিলে যে কোনো কাজ করা যায়, আর টাকা না দিলে যায় নোটিস আর উচ্ছেদ অভিযান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেবল একজন দুজনের নয়, অনেকের।
ভুক্তভোগী শাহজাহান আনসারীর দাবি, দুবার বদলি হলেও রিশাদ উন-নবী বহাল তবিয়তেই রয়ে গেছেন কউকে। তার সঙ্গে দেখা হলে রিশাদ উচ্চস্বরে বলেন, ‘আমি ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে বদলির আদেশ ঠেকিয়ে আপনার হোটেল ও রাস্তা ভাঙার জন্যই আছি!’
এদিকে সব অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু রিশাদ উন-নবী হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কোনো বিষয়ে আমার কথা বলার অনুমতি নেই। অভিযোগ থাকলে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
চেয়ারম্যানের নীরবতা
কউক চেয়ারম্যান মো. সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং)-এর সঙ্গে কথা বলুন। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি কোনো প্রকল্প পরিদর্শন করেননি এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগও নেই।
এ বিষয়ে কথা বলতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (ইঞ্জিনিয়ারিং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু নাঈম মো. তালাতের সঙ্গে কথা হলে তিনি হোটেল জামান সী হাইটস সম্পর্কে বলেন, ১৯৭৭ সালের লে-আউট প্ল্যানে কোনো সড়ক নেই। হোটেল মালিক ফেক কাগজপত্র বানিয়েছেন। অন্যদিকে স্যান্ডি বিচ রেস্টুরেন্ট ভাঙচুর সম্পর্কে বলেন, অবৈধ স্থাপনা হিসেবে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাদের আগেই নোটিস দেওয়া হয়েছে।