আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরিশালের চার আসনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা এবং তাদের কর্মী-সমর্থকরা। নিজ নিজ সংসদীয় আসনে এসব মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুঃসময়ে দলের নেতাকর্মীদের পাশে না থাকা, আন্দোলন সংগ্রামে নির্যাতিতদের খোঁজখবর না রাখা ও কোনো কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া), বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ- মুলাদী), বরিশাল-৪ (হিজলা-মেন্দিগঞ্জ) ও বরিশাল-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জোরালো হচ্ছে। এসব প্রার্থী বদলাতে বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রার্থী পরিবর্তন করা না হলে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করারও হুমকি দিচ্ছেন কেউ কেউ।
বরিশাল-১
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দীন স্বপন। এ আসনে মনোনয়ন চেয়ে এখনো নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবাহান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) আকন কুদ্দুসুর রহমান।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, স্বপনের মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই এ আসনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সোবাহান ও আকন কুদ্দুস সমর্থিত নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যেই প্রার্থী পরিবর্তন চেয়ে আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে তাদের সমর্থকরা। একই ভাবে আগৈলঝাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নেতাকর্মী স্বপনের মনোনয়ন বাতিল করে সোবাহানকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। এ দাবি নিয়ে তারা আগৈলঝাড়া উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, স্বপন ২০০১ সালে এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময় আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলায় হিন্দু নারী-পুরুষের ওপর নির্যাতন ও অসংখ্য হামলা-মামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় হাজার হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণ ভয়ে রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে বিএনপি নেতা সোবাহান হিন্দুদের রক্ষায় ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। যে কারণে এ আসন থেকে সোবাহানকেই মনোনয়ন দেওয়ার দাবি করছেন তারা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সোবাহানকে মনোনয়ন না দিলে নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন।
একই ভাবে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আকন কুদ্দুসুর রহমানের পক্ষেও দুই উপজেলায় নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। বিদ্রোহী দুই নেতার সমর্থকদের নানা কর্মসূচিতে অনেকটা চাপে পড়েছেন এ আসনে বিএনপির প্রার্থী স্বপন। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া সমমনা ইসলামী আট দলীয় জোটের প্রার্থীরা।
এ বিষয়ে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুস সোবাহান আমার দেশকে বলেন, এ আসনে বিএনপি থেকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি জনবিচ্ছিন্ন নেতা। এ কারণে মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলার মানুষ বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নেই। জনগণ চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব।
বরিশাল-৩
এই আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়নুল আবেদীনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ও মুলাদী উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুস সত্তার খান। ইতোমধ্যে এ দুই প্রার্থীর সমর্থকরা নির্বাচনি এলাকায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
জয়নুল আবেদীনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে গত বুধবার বিক্ষোভ মিছিল করে মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুস ছাত্তার খানের সমর্থকরা। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, এই আসনে জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তার মনোনয়ন বাতিল করা না হলে নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাছে হেরে যাবেন।
এছাড়া এ আসনে সেলিমা রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে গত সোমবার রাতে বাবুগঞ্জে মশাল মিছিল করেছেন তার সমর্থকরা। এর আগেও প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন সেলিমা রহমানের সমর্থকরা।
এ বিষয়ে জেলা যুবদলের সহসভাপতি আওলাদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, বিএনপির মনোনীত প্রার্থী জয়নুল আবেদীন একজন জনবিচ্ছিন্ন নেতা। স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। ইতোপূর্ব জয়নুল আবেদীন দুবার নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। সেলিমা রহমান জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি দুবার সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সেলিমা রহমান মাঠে ছিলেন। নেতাকর্মীদের সুখ-দুঃখে পাশে ছিলেন। তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনি বিজয়ী হবেন।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুস সত্তার খান আমার দেশকে বলেন, একজন জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। বিগত দিনে দুটি নির্বাচন করে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। একজন জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় সাধারণ ভোটার ও বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। জনগণ আমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। প্রার্থী পরিবর্তন না হলে আমি এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব।
বরিশাল-৪
এই আসনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দীন ফরহাদের সমর্থকরা।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মেজবাহ উদ্দীন ফরহাদ বলেন, আওয়ামী দুঃশাসনের সময় দীর্ঘ ১৭ বছর নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনি এলাকায় ছিলাম। একাধিকবার হামলা ও মামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু আমি মনোনয়ন না পাওয়ায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, যিনি এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন, তিনি আওয়ামী সরকারের আমলে ১৭ বছরে তার বাবা মারা যাওয়ার পর মাত্র একবার এলাকায় এসেছেন। এ কারণে এলাকার মানুষ তাকে মেনে নিতে পারছেন না।
বরিশাল-৫
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার। এ আসনেও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা নির্বাচনি মাঠ ছাড়েননি। বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় নেতা আবু নাছের মো. রহমাতুল্লাহ ও মহানগরের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাছরিন
এখনো নির্বাচনি মাঠে রয়েছেন। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করছেন তারা।
এ নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির প্রার্থী সরোয়ারের সামনেই তার সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছেন মনোনয়প্রত্যাশী নাছরিন। এ কারণে দলের মধ্যে বিরোধ আরো বাড়ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এভাবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নিজ দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন সরোয়ার। ফলে এ আসনে বিদ্রোহী প্রার্থীর দেখা মিলতে পারে।
বিএনপি যখন দলের অভ্যন্তরে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তখন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীরা। তারা বিএনপির এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের আশা, সামনের নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা বড় চমক দেখাতে সক্ষম হবেন।