পছন্দের লোকদের নিয়ে ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সাংগঠনিক অস্থিরতা আবারও তীব্র আকার ধারণ করেছে। দলীয় গঠনতন্ত্র বহির্ভূত ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি ঘিরে তৃণমূলে ক্ষোভ, বিভক্তি ও অবমূল্যায়ন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সালাউদ্দিন নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে মনগড়া কমিটি গঠন করে উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপিতে একক কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করেছিল।
তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, সুপার ফাইভ কমিটি গঠনের সময় দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়ায় সীতাকুণ্ড বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অধ্যাপক লায়ন আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিএনপির শক্ত ঘাঁটিতে সুপার ফাইভের কমিটি তৃণমূলে বিভক্তি ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ধানের শীষের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কাজী সালাউদ্দিনের নাম ঘোষণা করার পর তৃণমূলে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কাজী সালাউদ্দিনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলপথ প্রায় সাত ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরবর্তী ১৫ দিন ধরে সীতাকুণ্ড পৌর সদরসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এবং আকবর শাহ, উত্তর পাহাড়তলী ও কর্নেলহাট এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কর্নেলহাট ও সিটি গেইট থেকে বড়দারোগাহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব ও কাজী সালাউদ্দিনের বড় ভাই কাজী মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে দলীয় গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দলীয় ফান্ডের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে গত ২২ নভেম্বর উপজেলা বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ নেতাকর্মী স্বাক্ষরযুক্ত রেজুলেশন পাস করেন। রেজুলেশনে তাকে সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সলিমপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রনেতা জাহেদুল হাসান আমার দেশকে বলেন, ২০২২ সালে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকার মোট ৯০টি ওয়ার্ডে দলীয় গঠনতন্ত্র বহির্ভূত সুপার ফাইভ কমিটি করা হয়। ওই সময় দলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী বহু নেতাকে বাদ দিয়ে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সুপার ফাইভের কমিটি করা হয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রোষানলের শিকার হয়ে লায়ন আসলাম চৌধুরী দীর্ঘ বছর যাবৎ কারাগারে আটক ছিলেন। এই সুযোগে কাজী সালাউদ্দিন উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির কমিটি থেকে অধ্যাপক আসলাম চৌধুরীকে মাইনাস করে সীতাকুণ্ডে বিএনপির রাজনীতিতে একক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি আরও বলেন, আজ পর্যন্ত সুপার ফাইভের কোনো ইউনিয়নের কমিটি অনুমোদন পায়নি।
বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সালামত উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গসংগঠনের কোনো নেতাকর্মী কাজী সালাউদ্দিন ও কাজী মহিউদ্দিনের সঙ্গে নেই। কয়েকজন ইট-বালু ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীই তাদের ভরসা। বিভিন্ন ইউনিয়নে সুপার ফাইভের কমিটিগুলো না ভাঙলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সীতাকুণ্ড আসনে বিএনপি বড় ঝুঁকিতে পড়বে।
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি ও ছাত্রনেতা আশেক ইলাহী আমার দেশকে বলেন, আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভা বিএনপির এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করে দেশের মধ্যে একটি মডেল উপজেলায় রূপান্তর করেছিলেন। আসলাম চৌধুরীর দীর্ঘ বছর যাবত কারাগারে অন্তরীণ থাকায় এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কাজী সালাউদ্দিন সুপার ফাইভের নামে দলীয় গঠনতন্ত্রবিরোধী কমিটি দিয়ে বিএনপির ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছেন। তিনি আরও বলেন, সুপার ফাইভের প্রতিটি কমিটিই ‘ওয়ানম্যান সু’ যাদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনো সম্পর্ক নেই।
সীতাকুণ্ড পৌরসভা বিএনপির সদস্য সচিব ছালে আহাম্মদ ছলু আমার দেশকে বলেন, কাজী সালাউদ্দিনের এমপি হওয়ার মতো কোন যোগ্যতাই নেই। তাছাড়াও কাজী সালাউদ্দিন জীবনে কখনো গ্রেপ্তার হননি, এমনকি একদিনের জন্য কারাগারে যাননি। কাজী সালাউদ্দিন আন্দোলন সংগ্রামে এবং দলের চরম দুঃসময়েও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন না। সুতরাং এমন প্রার্থীকে তৃণমূল প্রত্যাখ্যান করাটাই স্বাভাবিক। সীতাকুণ্ড সংসদীয় আসনে বিজয়ী হওয়ার যোগ্য একমাত্র প্রার্থী হলেন লায়ন আসলাম চৌধুরী এফসিএ।
৯০–এর দশকের ছাত্রনেতা ও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল আলম জহুর আমার দেশকে বলেন, যারা আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন, পুলিশের গুলি, টিয়ারগ্যাস খেয়েছেন, দলের জন্য ত্যাগী নেতারা সুপার ফাইভের কমিটিতে নেই। কাজী সালাউদ্দিন ও কাজী মহিউদ্দিন সীতাকুণ্ড বিএনপিকে সুপার ফাইভের কমিটির মাধ্যমে আসলাম চৌধুরীর হাতের গড়া সংগঠন বিএনপির দুর্গে আঘাত হেনেছে। বর্তমানে উপজেলা বিএনপি ও পৌরসভা বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের পাশে নেই।
তিনি আরও বলেন, লায়ন আসলাম চৌধুরী সীতাকুণ্ডের গণমানুষের আস্থার প্রতীক। আগামী নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দল মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির পেশার মানুষের এবং তৃণমূলের মতামতকে সম্মান জানিয়ে কাজী সালাউদ্দিনের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে সীতাকুণ্ড সংসদীয় আসনে অধ্যাপক আসলাম চৌধুরী নাম ঘোষণা করার আহ্বান জানান।
জহুরুল আলম জহুর আরও বলেন, সুপার ফাইভের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো বাতিল করে ত্যাগী নেতাদের নিয়ে নতুন কমিটি না করলে আগামী নির্বাচনে সীতাকুণ্ড আসন বিএনপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।