ফেনী-৩ (দাগনভূঞা-সোনাগাজী) আসনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। আসনটিতে দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর জামায়াত তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. ফখরুদ্দিন মানিককে প্রার্থী দিয়েছে। বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীর বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন জামায়াতের অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থী। তাই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে নবীন-প্রবীণের লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন ভোটাররা।
এদিকে আসনটির সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলায় বিএনপির কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে চলছে বিরোধ। পাল্টাপাল্টি শোডাউন, সংঘাত, বহিষ্কার ও ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের মধ্যস্থতায় দুপক্ষকে নিয়ে দফায় দফায় সমঝোতা বৈঠক হলেও এখনো বিরোধ মেটেনি। প্রকাশ্য কোন্দলের কারণে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত। এ নিয়ে তৃণমূলে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা ও ক্ষোভ।
এর মাঝেই গত সপ্তাহে দলীয় হাইকমান্ড থেকে আবদুল আউয়াল মিন্টুকে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সোনাগাজীতে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন বাবলুর নেতৃত্বে এবং দাগনভূঞায় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মিন্টুর ছোট ভাই আকবর হোসেনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের একাংশকে নিয়ে আনন্দ মিছিল করে।
দলীয় দ্বিধাবিভক্তির কারণে সোনাগাজী বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন সেন্টু এবং দাগনভূঞায় বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আবুল হাসেম বাহাদুর ও পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কাজী সাইফুর রহমান স্বপন এবং তার ছোট ভাই জেলা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত নেতা কাজী জামশেদুর রহমান ফটিকের নেতৃত্বাধীন বিবদমান অপর অংশের নেতাকর্মীরা এসব কর্মসূচি এড়িয়ে চলছেন।
এরই মধ্যে নিজেদের গ্রুপের এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগে আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছোট ভাই আকবরকে দায়ী করে কয়েক দিন আগেও দাগনভূঞা শহরে প্রতিবাদী বিক্ষোভ করেছেন ফটিকের নেতৃত্বে মিন্টু পরিবারের প্রতিপক্ষরা। এসব কারণে এখনো আসনটিতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান। যার প্রভাব পড়তে পারে ভোটের মাঠে।
অন্যদিকে এ আসনে পোস্টার লাগিয়ে নিজের প্রার্থিতা জানান দিয়েছেন জেএসডি (রব) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন। বিগত সময়ে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলনের অবদান হিসেবে শরিক থেকে তিনি আসনটি দাবি করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
বিএনপি থেকে এই আসনে আবদুল আউয়াল মিন্টুকে প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন কি-না সেটা নিয়েও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয়ের গুঞ্জন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মিন্টুর ছোট ভাই আকবর হোসেন অথবা ছেলে তাফসির আউয়াল কিংবা তাজওয়ার আউয়ালকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে চাইতে পারেন তিনি। এছাড়া মিন্টুর স্ত্রী উইমেনস এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসরীন ফাতেমা আউয়াল শেষ পর্যন্ত এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন তার সমর্থকরা।
অপরদিকে, এই আসনে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন জামায়াতে ইসলামী মনোনীত ডা. মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন মানিকও। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চরম জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন দল ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারা। নির্যাতনের খড়্গ থেকে বাদ যাননি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক এই কেন্দ্রীয় সভাপতি। প্রায় ৮০টি মামলায় কারাগার ও আদালতের কাঠগড়ায় কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। ছাত্রসংগঠন থেকে বিদায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত হয়েই ফেনী-৩ আসনে দলীয় মনোনয়ন পান তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে দাগনভূঞা-সোনাগাজীর প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন ডা. মানিক ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। কয়েক মাস আগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় আমির ডা. শফিকুর রহমান দাগনভূঞায় সমাবেশে মানিককে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই থেকে ব্যাপক প্রচারণার মধ্য দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদেরও উজ্জীবিত করে রেখেছেন তিনি।
এর বাইরেও আসনটিতে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের (মামুনুল হক) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা এনামুল হক মুসা, খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ আলি মিল্লাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মহানগরের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সাইফুদ্দিন শিপনকে নিজ নিজ দলের একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তারাও নিজ দলের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির পক্ষ থেকেও একজন দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এ আসনটির সীমানা ছিল সোনাগাজী উপজেলা ও ফেনী সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তা পরিবর্তন হয়ে ফেনী-২ আসন থেকে দাগনভূঞাকে কেটে ফেনী-৩ আসনে সংযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে এ আসন দাঁড়িয়েছে সোনাগাজী উপজেলার একটি পৌরসভা, ৯টি ইউনিয়ন ও দাগনভূঞা উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে।
সাধারণ ভোটারদের মতে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি থেকে আবদুল আউয়াল মিন্টু ধানের শীষের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনি মাঠে নামলে তার সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে জামায়াত প্রার্থী ডা. মানিকের।
১৯৯১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এ আসন থেকে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন বিএনপির মাহবুবুল আলম তারা। ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি প্রয়াত মো. মোশাররফ হোসেন এমপি নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন করে। ওই নির্বাচনে জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি মো. মোশাররফ হোসেন এমপি নির্বাচিত হন। একইভাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনেও বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে মো. মোশাররফ হোসেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালে ফ্যাসিস্ট আমলে দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি-জামায়াতের ভোট বর্জনের সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন লাঙ্গল প্রতীকের জাতীয় পার্টির নেতা রিন্টু আনোয়ার। তিনি ভোট বর্জন করলে স্বতন্ত্রের ব্যানারে তখন এমপি হয়ে যান আওয়ামী লীগের রহিম উল্যাহ। ২০১৮ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট আন্তর্জাতিক চাপে নির্বাচনে গেলেও আগের রাতেই আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির কাছে হেরে যান ধানের শীষের প্রার্থী আকবর হোসেন। এ নির্বাচনে জাপার ব্যানারে ১৪ দলের হয়ে এমপি হয়ে যান ১/১১’র খলনায়ক লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর একতরফা নির্বাচনেও ডামি প্রার্থী করিয়ে ভোটার শূন্য কেন্দ্রে আওয়ামী নেতাকর্মীদের মাধ্যমে বাক্স ভর্তি করে এমপি সেজেছিলেন মাসুদ। চব্বিশের ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে হাসিনার নির্দেশে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে জড়িয়ে তিনিও এখন পলাতক।