সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের শিক্ষা জীবন সম্পর্কে তেমন ধারণা না পাওয়া গেলেও কর্মজীবন শুরু হয় রৌমারী বাজারের গরু বেচাকেনার দালালি, চালান লেখা এবং সীমান্তের মাদক ও চোরাচালান ব্যবসা দিয়ে।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম হাবিব দুলাল জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট থেকে আবারো তাকে মনোয়ান দিলে আওয়ামী লীগ থেকে জাকির হোসেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচন করেন।
সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই ‘আলাদীনের চেরাগ’ হাতে পান তিনি। মেতে ওঠেন অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের নেশায়।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে জয়ী হয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর আরও ‘ভয়ংকর’ হয়ে ওঠেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।
তার ছত্রছায়ায় নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাজি, বালু মহল নিয়ন্ত্রণ, হাট-বাজার ইজারা নিয়ন্ত্রণ, নৌকা ঘাট ইজারা নিয়ন্ত্রণ, ভূমি দখল, মামলা বাণিজ্য, সীমান্তে মাদক ও গরু চোরাকারবারিসহ তৈরি হয় নানা ত্রাসের রাজত্ব।
সরেজমিন ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য থেকে উঠে এসেছে তার এসব অপকর্মের 'ভয়ংকর' চিত্র।
মাদকের পৃষ্ঠপোষক-
২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই সীমান্তে মাদক ও চোরা চালানের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন জাকির। পরবর্তীতে মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেও ‘মাদকের পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে গোয়েন্দা রিপোর্টে তার নাম আসে।
২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাকিরের মাইক্রোবাসে ইয়াবাসহ তার গাড়ি চালক রফিকুলকে আটক করে র্যাব-১৪ এর একটি দিল। এর আগে কুড়িগ্রামের মোগলবাসা থেকে জাকিরের সহযোগী বাবলুকে আটক করে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ।
জানা যায়, প্রতি রাতে জাকিরের মাদক সিন্ডেকেটের মাধ্যমে রৌমারী সীমান্ত থেকে জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, বগুড়া, গাজীপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাদক সরবরাহ করা হতো। আর এসব কাজে ব্যবহার করা হতো উঠতি বয়সী তরুণ ও মহিলাদের।
জাকিরের দখল বাণিজ্য-
এলাকার সহজ-সরল মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে আবার কখনো ভয়-ভীতি দেখিয়ে জায়গা দখল করতেন জাকির। চরশৌলমারী ঈদগাহ মাঠের আড়াই একর জায়গা দখল করেন নির্মাণ করেন ব্যক্তিগত স্থাপনা, যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। তুরা রোডের পাশে ৭০ শতক জায়গা দখল করে তার ছেলে গড়ে তোলেন পাথরের ব্যবসা, যার মূল্য প্রায় দু’কোটি টাকা। পাশেই গুচ্ছ গ্রামের ১৫ শতক জায়গাসহ মোট দু’একর জায়গা দখল করে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। জন্তিরকান্দা নামক স্থানে এক একর জায়গা দখল করে তার স্ত্রীর নামে গড়ে তোলেন ‘শিরি অটো রাইস মিল’, যার বর্তমান মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। দইখাওয়ায় পাঁচ একর,ও কুটিরচরে এক একর জায়গা দখলে নেন যার মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা।
দাঁতভাঙা এক একর জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন মাজার ও দোকান ঘর, যার মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এছাড়াও জামালপুরে ৪০ একর জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন মায়ের নামে মাজার, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
জাকিরের জমি দখল নেশায় সর্বস্ব হারিয়ে রৌমারীর বয়োবৃদ্ধ জালাল মাস্টার বলেন, ‘আমাকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো ঘর সরিয়ে নিতে। আমি সরিয়ে নিলাম। তারপরও আমার রেকর্ডকৃত জমিতে বালু ফেলে দখলে নিয়েছে। জায়গাতেও লোকসান, টাকাতেও লোকসান। কী করমু, তার ক্ষমতার কাছে আমরা টিকতে পারি না। এখানে যে জায়গা দখলে নিয়েছে তার অর্ধেক খাস আর অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানাধীন কারও জমির টাকা দেয় নাই।’
বাড়ি ও সুপারমার্কেট নির্মাণ
মন্ত্রী হয়েই রৌমারী বাজারের পাশেই তৈরি করেন দোতলা আলিশান বাড়ি। এছাড়া রৌমারী বাজারের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পাশে চার তলা সুপার মার্কেট নির্মাণ, কর্তিমারী বাজারে জায়গা দখল করে চার তলা সুপার মার্কেট নির্মাণ, রাজিবপুর বাজারে সরকারি পুকুর দখল করে গুদাম ঘর নির্মাণ, রাজিবপুর শিশু উদ্যানের পাশে ১০ শতক জায়গায় পাকা বাড়ি নির্মাণ, কুড়িগ্রাম শহরের কুমার পাড়ায় ২০ শতক জায়গায় তিন তলা বাড়ি নির্মাণ, পূর্বাচলের ১০ শতক জায়গায় বাড়ি নির্মাণ, রংপুরে ৪০ শতক জায়গা ক্রয়, এছাড়াও আমেরিকায় বাড়ি কিনেছেন বলেও বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে।
নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদের বিবরণ
২০০৮ সালে নির্বাচনী হলফনামায় জাকির তার বাৎসরিক আয় দেখান এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং নগদ অর্থসহ মোট সম্পদের পরিমাণ দেখান ১৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ৫ বছর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য থাকার পর ২০১৩ সালের নির্বাচনী হলফনামায় বাৎসরিক আয় দেখান ১৪ লাখ ৪২ হাজার ২৯৫ টাকা এবং মোট সম্পদের পরিমাণ দেখান ৮৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৩ টাকা।
এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তার বাৎসরিক আয় দেখানো হয় মাত্র দু’লাখ ৭৯ হাজার টাকা, তবে নগদ অর্থসহ মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় পাঁচ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার ৬৩ টাকা।
কর্মস্থলে না গিয়েও বেতন উত্তোলন
১৪ বছর কর্মস্থলে না গিয়েও নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করতেন জাকিরের স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা। সুরাইয়া দাঁতভাঙা ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা নির্দেশিকা পদে কর্মরত ছিলেন।
জানা যায়, জাকির ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তার স্ত্রী কোনোদিন অফিসে না গিয়েও নিয়েছেন সব ধরনের সুযোগ সুবিধা।
প্রতিমন্ত্রী জাকিরের সবধরনের অপকর্মের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন বোন শিউলী আক্তার, ভগ্নিপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মামা ওয়াজেদ ইসলাম, গাউসুল আজম, স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা, ছেলে সাফায়ত বিন জাকির, চাচাতো ভাই মোস্তাফিজ রবিন, মারুফ, মশিউর, রাসেদ, মাসুম এবং হত্যা ও গুম মামলার অন্যতম আসামি, কথিত বড় ভাই সুরুজ্জামাল।