চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বাজদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ইমরান হোসেন এবার আগাম জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন ২০ কাঠা জমিতে। বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে অর্ধেক ফসল। বাকি ১০ কাঠায় ফলন হয়েছে ২০ মণের মতো। নিজের ও স্বজনদের জন্য দুই মণ রেখে বাকি পেঁয়াজ সপ্তাহ দেড়েক আগেই ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইমরান হোসেনের মতো আরো অনেক কৃষক আগাম জাতের পেঁয়াজ চাষ করেছেন। ওইসব ক্ষেতের পেঁয়াজ এরই মধ্যে উঠতে শুরু করেছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব পেঁয়াজ বাজারে আসবে। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির খবরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
জীবননগর বাজদিয়া গ্রামের কৃষক আসাদ আলী আমার দেশকে বলেন, এবারো দেশে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হবে। আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পুরোদমে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে। ফলে এ সময়ে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলে আমরা দাম পাব না। আমার মতো হাজার হাজার কৃষক পুঁজি হারিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান, যেন এ মুহূর্তে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি না দেওয়া হয়। তার মতো আহ্বান প্রায় সব পেঁয়াজচাষির।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন আমার দেশকে বলেন, এ মুহূর্তে দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। এখনো কৃষকের হাতে তিন লাখ টন পেঁয়াজ রয়েছে। বাজারেও সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৮৭ হাজার টন এবং ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে আরো আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। ফলে কোনো ধরনের সংকট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অসাধু সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমদানির পাঁয়তারা করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তার মতে, আগাম জাতের পেঁয়াজ আসতে শুরু করায় এবং কৃষকের হাতের পেঁয়াজ বাজারে ছেড়ে দেওয়ায় এরই মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। দু-তিনদিনের মধ্যে আরো কমে আসবে। ফলে এ মুহূর্তে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। অসাধু ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এ মুহূর্তে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে আমাদের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ও এমন মনোভাব পোষণ করে বলে জানান তিনি।
ড. জামাল উদ্দীন বলেন, বিগত ১৫ বছরে যারা বিভিন্নভাবে সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, তারা এখন সুবিধা করতে পারছে না। ফলে বাজার অস্থির করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে ওই চক্রটি। তবে কারসাজি করে দাম বাড়ালে কৃষকরাই হাতের পেঁয়াজ ছেড়ে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইমপোর্ট পারমিশন (আইপি) দেওয়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হাতে। বাজার পরিস্থিতি, কৃষকের স্বার্থ ও উৎপাদন পর্যালোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক (আমদানি) বনি আমিন খান বলেন, পেঁয়াজ আমদানির বিষয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমতি না দিলে আইপি দেওয়া যায় না। পেঁয়াজ আমদানির জন্য দুই হাজার ৮০০-এর বেশি আবেদন পড়েছে।
গত রোববার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দাম কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না কমলে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ। স্থানীয় উৎপাদন থেকেই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ হচ্ছে বাজারে। তবে এখন মৌসুমের শেষে মজুত কমে আসায় বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। বছরজুড়ে স্থিতিশীল থাকলেও গত দেড় সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দাম ৩০ টাকা বেড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকার পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা।
গত মঙ্গলবার বিকালে কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা শাহীন মিয়া বলেন, সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যে পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি; তা আজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। আমাদের আড়ত থেকেই কিনতে হচ্ছে ১০৩ থেকে ১০৭ টাকা দরে।
টিসিবির তথ্যে দেখা যায়, গত বছর এ সময়ে পেঁয়াজের দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। সে হিসেবে বর্তমানে গতবারের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।
আব্দুল কাদের নামে অপর ব্যবসায়ী আমার দেশকে বলেন, বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরবরাহ কমে দাম বাড়লে সাধারণত দুই থেকে চার টাকা বাড়ে; কিন্তু কদিনে কেজিতে ২০-৩০ টাকা বৃদ্ধির ঘটনা রহস্যজনক। তার মতে, ভারতে এখন পেঁয়াজের কেজি ৩০ টাকার মতো; ফলে কম দামে আমদানি করে ব্যবসায়ীরা লাভবান হতেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে।
শ্যামবাজারের এক আড়তদার বলেন, দেশি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও আমদানিকারকরা ভারত থেকে কম দামে পেঁয়াজ আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তারাই সিন্ডিকেট করে দেশের বাজারে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে আমদানির সুযোগ তৈরির চেষ্টা করছেন। বছরের শেষ সময়ে এসে প্রতিবছরই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বাজার থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নেয় কারসাজিচক্র।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে। দেশে ভালো উৎপাদন হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আমদানির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এ কাজটি তারা প্রতিবছরই করে থাকে। ফলে এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।