ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) দীর্ঘদিনের লোকসান-পরবর্তী স্থবিরতা কাটিয়ে অবশেষে পূর্ণাঙ্গভাবে সচল হওয়ার পথে। পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছে বিদেশি অপারেটর কোম্পানি সুইজারল্যান্ডের মেডলগ। প্রতিষ্ঠানটি আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বুঝে নেবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, নতুন ব্যবস্থাপনায় টার্মিনালটি লাভের মুখ দেখবে এবং দেশের বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বিদেশি অপারেটর আসলেও লাভ হবে না, যদি কাস্টমসের হয়রানি, জাহাজ ভাড়া ও ব্যয় কমানো না যায় ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৬৪ একর জমির ওপর পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করে। এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ১৫৪ কোটি টাকা। বছরে অন্তত দুই লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে টার্মিনালটির। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক কনটেইনারের ৯৪ শতাংশ সড়কপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করে। রেলপথে পরিবহন হয় চার শতাংশ। নৌপথে এই হার মাত্র এক শতাংশ। গত নভেম্বরে এক চুক্তির মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগকে ২২ বছরের জন্য পানগাঁও টার্মিনাল পরিচালনার ভার দেয় বন্দর। জানুয়ারির প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে টার্মিনালটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বুঝে নেবে বিদেশি এ অপারেটর।
এর আগে, লালদিয়ার প্রকল্পে বাংলাদেশের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী (ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার) বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) প্রতিবেদনে টার্মিনাল অপারেটরের (এপিএম টার্মিনালস) প্রস্তাব জমা দেওয়ার পর চুক্তি পর্যন্ত কার্যক্রম শেষ করতে ৬২ দিন সময়সীমা ধরা হয়েছিল। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ অস্বাভাবিক দ্রুততায় মাত্র দুই সপ্তাহে এই কার্যক্রম শেষ করেছে। জানা গেছে, ৪ নভেম্বর এপিএম টার্মিনালস কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব দাখিল করে। ৫ নভেম্বর প্রস্তাবের কারিগরি মূল্যায়ন করা হয়। আর ৬ নভেম্বর আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের পর ওই দিনই শুরু হয় দর কষাকষি।
বন্দর সূত্র জানায়, সরকারি ছুটির মধ্যে ৭ ও ৮ নভেম্বর দর কষাকষি শেষ হয়। তবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ৯ নভেম্বর দর কষাকষি শেষ হয়েছে। একই দিন বন্দরের বোর্ড সভায় এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সভায় অনুমোদনের পর সারসংক্ষেপ একই দিন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরদিন তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আর ১২ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই প্রস্তাব তোলা হলে তা অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। অস্বাভাবিক দ্রুততায় মাত্র দুই সপ্তাহে চুক্তি সম্পন্ন করায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানায়, এখানকার ব্যবস্থাপনার অধীনে মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে। নতুন বিনিয়োগের আওতায় প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা খরচ করে আধুনিকীকরণ, যন্ত্রপাতি সমন্বয় এবং পরিবহন ব্যবস্থার অটোমেশন নিশ্চিত করা হবে। এখানে দুটি মোবাইল হারবার ক্রেন, আধুনিক হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি, ১০ হাজার বর্গমিটার কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন এবং একটি বিশেষায়িত কটন ওয়্যারহাউস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া পরিবহনের জন্য মেডলগ নিজস্ব ধরনের বার্জ ও বিশেষ জাহাজ ব্যবহার করবে। এটি শুধু একটি টার্মিনাল নয়, বরং ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং আশপাশের শিল্পাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক হাব হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পানগাঁও সম্পূর্ণরূপে সচল হলে সড়কপথের ওপর চাপ কমবে এবং নৌপথে কম খরচে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম করা সম্ভব হবে। বন্দরের নতুন ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও কিছু উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পণ্য পরিবহনের অনেকটাই বায়ারদের ওপর নির্ভরশীল। তবে জাহাজ ভাড়া কমালে এবং জাহাজের সংখ্যা বাড়ালে মেডলগের পক্ষে সফলভাবে টার্মিনাল চালানো সম্ভব হবে এবং এটা লাভজনক হবে।
তিনি আরো বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য শুধু অপারেটর পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আতঙ্ক কাটাতে কাস্টমস প্রক্রিয়া দ্রুত করা, জাহাজঘাটের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ কমানোসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানগাঁও টার্মিনাল কেবল ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটই নয়, ভবিষ্যতে মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের শিল্প সাপ্লাই চেইনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নতুন ব্যবস্থাপনায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য এটি একটি শক্তিশালী টার্মিনাল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, যা বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।