হোম > আইন-আদালত

অবশেষে কাঠগড়ায় ১৫ আর্মি অফিসার

স্টাফ রিপোর্টার

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কর্মরত থাকা অবস্থায় এতসংখ্যক সেনা অফিসারকে সিভিল আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হলো।

তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আগে থেকেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে শীতল মতবিরোধ চলে আসছিল। কিন্তু গতকাল তাদের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিরোধটির একটি সুন্দর সমাধান হলো। আর এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো অপরাধে অভিযুক্ত যত বড় পদেই থাকুক তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।

গতকাল বাড়তি নিরাপত্তার মধ্যে সকাল সোয়া ৭টায় ট্রাইব্যুনালের ফটক দিয়ে ঢোকে বাংলাদেশ জেল-প্রিজন ভ্যান লেখা সবুজ রঙের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি গাড়ি। ওই গাড়িতেই ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় ১৫ সেনা অফিসারকে । এরপর সকাল সাড়ে ৭টায় প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে একে একে সবাইকে ট্রাইব্যুনালের নিচ তলায় অবস্থিত হাজতখানায় নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা।

একটু পর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে সেনা অফিসারদের এজলাস কক্ষে তোলা হয়। এ সময় তারা সবাই ছিলেন সাধারণ পোশাকে। এর পরপরই মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিন মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের পর ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী ।

এ সময় সেনা কর্মকর্তাদের পক্ষে আইনজীবীরা বক্তব্য দিতে চাইলে আদালত যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পরবর্তী তারিখে বক্তব্য দেওয়ার কথা বলে। ট্রাইব্যুনাল গুমের অভিযোগে করা দুটি মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ নভেম্বর ধার্য করে। আর গত বছরের ১৮ ও ১৯ জুলাই রামপুরায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগে করা মামলায় শুনানির জন্য ৫ নভেম্বর দিন ধার্য করে ।

কারাগারে পাঠানো সেনা কর্মকর্তারা হলেন—র‍্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন ও কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (এখন অবসরকালীন ছুটিতে), র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত-বিন-আলম ।

কারাগারে পাঠানো ডিজিএফআইয়ের সাবেক তিনজন পরিচালক হলেন— মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজাহার সিদ্দিকী ।

ট্রাইব্যুনাল থেকে সাবজেলে

ট্রাইব্যুনালের আদেশের পর আসামি ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রিজন ভ্যানে উঠানো হয়। বেলা সোয়া দশটার দিকে ঢাকা সেনানিবাসের সাবজেলের উদ্দেশে প্রিজন ভ্যানটি ছেড়ে যায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত ঢাকা সেনানিবাসের সাবজেলে (এম ই এস বিল্ডিং নম্বর-৫৪) তাদের রাখা হবে বলে আইজি প্রিজন ও আসামিদের আইনজীবী সাংবাদিকদের জানান।

হাসিনাসহ পলাতক ১৭ আসামির বিরুদ্ধে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ তিনটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের হাজিরের জন্যে একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ।

পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য আবেদন করেন চিফ প্রসিকিউটর। তার আবেদন আমলে নিয়ে গতকাল থেকে আগামী সাত দিনের মধ্যে আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য দুটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

যাদের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে তারা হলেন—শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, র‍্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পাঁচজন মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক, র‍্যাবের সাবেক তিন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ (পরে আইজিপি হন), এম খুরশিদ হোসেন ও মো. হারুন-অর-রশিদ এবং পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান।

সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে

আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার ব্যাপারে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে বলে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

গতকাল সেনাসদস্যদের কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আজ (বুধবার) যাদের উপস্থিত করা হয়েছিল, তাদের গ্রেপ্তার ও সোপর্দ করার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন কাজ করেছে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের রক্ষক হিসেবে আমরা যাদের মনে করি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তারা এই আদালতের (ট্রাইব্যুনালের) বিচারিক প্রক্রিয়াকে সাহায্য করেছে। তারা (সেনাবাহিনী) ঘোষণা দিয়েছিল, ল অব দ্য ল্যান্ডের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল থাকবে, বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি তাদের সব সমর্থন থাকবে। তারা সে সমর্থন আমাদের দিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়েছে ।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করতে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। সুতরাং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা অপপ্রচার করেন, তাদের বলব অপপ্রচার করবেন না। তারা জুলাই-আগস্টে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের সময় ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তা জাতি স্মরণ করে। এখন গুমের বিচারেও সহযোগিতা করছে।

আত্মসমর্পণকারী সেনা কর্মকর্তারা

নির্দোষ : আইনজীবী

গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সেনাসদস্যরা নির্দোষ বলে দাবি করেন তাদের আইনজীবী। সেনাসদস্যদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন বলেন, সেনা কর্মকর্তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন, তারা নির্দোষ। এ মামলার মূল অপরাধীরা ভারতে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু আমার মক্কেলরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, এর আগে সেনা সদরের আদেশে সংযুক্তকৃত ১৫ জন অফিসার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সারেন্ডার করেন। তারা অনেক সিনিয়র অফিসার, অভিজ্ঞ অফিসার। আন্তর্জাতিক বাহিনীতেও অনেকে চাকরি করেছেন। তারা আশা করেন, এ আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন।

প্রসিকিউশন এই সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে আনার কথা জানিয়েছিল। সে বিষয়ে আইনজীবী সরোয়ার বলেন, আমরা জানি তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। পুলিশের মাধ্যমে তারা কোর্টে সারেন্ডার করেছেন। সেটাকে তারা বলেছেনÑতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা কখনোই গ্রেপ্তার ছিলেন না। আগে সেনা সদর ব্রিফিং করেছিল, সেখানে তারা বলেছিলÑতারা আর্মি হেফাজতে আছেন।

জেনারেল ওয়াকারের বক্তব্য ঘিরে ধূম্রজাল

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়। অনেকে ওই বক্তব্যকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া সেনাসদস্যদের পক্ষে প্রচেষ্টা হিসেবে প্রচার করে। যদিও পরে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুম-খুনে জড়িত সেনা অফিসারদের সংক্রান্ত নয় বলে ভাষ্য দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অফিসারদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে তা কল্পনা করতেও আমার কষ্ট হয়। আমাদের ব্রাদার অফিসারদের এ অপমানের মুখোমুখি হতে হবে, আমরা এটা কীভাবে সহ‍্য করব?’

৩৪ গুম ও জুলাইয়ে রামপুরায়

২৮ হত্যার অভিযোগ

আসামিদের বিরুদ্ধে জেআইসি তথা আয়নাঘর এবং টিএফআই তথা র‌্যাবের আয়নাঘরের মাধ্যমে মোট ৩৪টি গুমের ঘটনা সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের মামলায় ১৭ জন এবং জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের মামলায় আসামি ১৩ জন।

টিএফআই সেলে বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে জেআইসিতে বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে ।

অনুমান করা হয়, আওয়ামী সরকারের শাসনামলে দেশে প্রায় সহস্রাধিক গুমের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যে গুম কমিশন মোট এক হাজার ৮৩৭টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, গুমের শিকার ৩৪৫ ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৮ ও ১৯ জুলাই রামপুরায় বিজিবি ও পুলিশের গুলিতে ২৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিজিবিতে কর্মরত দুই লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন: চিফ প্রসিকিউটর

১৫ সেনা কর্মকর্তার পক্ষে লড়বেন না ব্যারিস্টার সরোয়ার

বুয়েটের সেই শ্রীশান্তের জামিন নামঞ্জুর

হত্যার মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকেরকে অব্যাহতির সুপারিশ

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের তিন সহযোগী রিমান্ডে

হাসিনাসহ ৩ জনের রায়ের দিন ঘোষণা ১৩ নভেম্বর

হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি চাইলেন অ্যাটর্নি জেনারেল

বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার দাবি গুমের শিকারদের

গুমে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার জবাবদিহিতা নিশ্চিতের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কোনো আপিল শুনানি হবে না