জুলাই বিপ্লবের সময় সারাদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে সর্বোচ্চ দায় এবং কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিচার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২–এ।
সোমবার মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মো. রাইসুল হক। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গত বছরের জুলাই আন্দোলনে শর্টগানের গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার সময় তাঁর মুখ থেকে একটাই কথা বের হয়েছিল—“ভাই, আমার লাশ যেন বিজয় মিছিলে যায়, লাশ যেন দাফন না করা হয়।”
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী অনুপস্থিত থাকায় সদস্য বিচারক অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীরের উপস্থিতিতে বিচারকাজ শুরু হয়।
রাইসুল হক জবানবন্দিতে বলেন, গত বছরের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে মন্তব্য করার পর রাতেই কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ এলাকায় তারা মিছিল করেন। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর কুষ্টিয়ার শাপলা চত্বর থেকে মজমপুর পর্যন্ত তাদের বিশাল মিছিল পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বাধা সত্ত্বেও সম্পন্ন হয়।
সাক্ষী রাইসুল জানান, ১৮ জুলাই ডিসি কোর্ট মোড়ে ৩০০–৪০০ আন্দোলনকারী জড়ো হলে ডিবি পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের হামলার মুখে পড়েন তারা। ছত্রভঙ্গ হয়ে আবার একত্রিত হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টিয়ারশেল ও গুলি চালায়। তিনি বলেন, তার কপালের মাঝখানে শর্টগানের গুলি লাগে—সেই ক্ষতচিহ্ন তিনি ট্রাইব্যুনালে দেখান।
রাইসুল বলেন, ১৮ জুলাইয়ের পরে তারা আর একত্রিত হতে পারেননি। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের সামনে থেকে মজমপুর অভিমুখে মিছিল বের করেন তারা। তখন ২ থেকে ৩ হাজার ছাত্রজনতা অংশ নেন। সেদিন আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। তিনি বলেন, এ হামলায় সরাসরি নির্দেশ ও উসকানি দিয়েছেন কুষ্টিয়ার ২ আসনের এমপি ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতাসহ স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা।
জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকাল ১১টা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের সামনে তারা একত্রিত হন । এরপর তারা মিছিল বের করেন। তখন ৪ থেকে ৫ হাজার ছাত্রজনতা কর্মসূচিতে অংশ নেন। মিছিলে একপর্যায়ে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ওপর স্বশস্ত্র হামলা চালায়। পরে বক চত্তরের পাশে বাবু নামে একজন আন্দোলনকারীর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সেদিনই বক চত্তরের আশেপাশে সুরুজ আলী বাবু, বাবুল ফরাজী, আব্দুল্লাহ মুস্তাকিন, উসামাসহ মোট ০৬ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন।
তিনি বলেন, পরে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনাকে ফোন কলের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে আন্দোলনকারীদের গুলি করা, বোম্বিং করা, যেকোন মূল্যে আন্দোলন দমন করার পরামর্শ ও উসকানি দেন ইনু। সাক্ষী রাইসুল গত বছরে জুলাই আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ছাত্রজনতার উপর হামলা এবং শহীদদের ওপর হামলার প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা ও উসকানিদাতা হিসাবে হাসানুল হক ইনুর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানান।
জবানবন্দি শেষে তাকে ইনুর আইনজীবীরা জেরা করেন। এদিন দুজন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। অপরজন হলেন তানভীর হাছান জোহা।
এসআর