ঢাকা থেকে দক্ষিণে সুন্দরবনের পথে যাত্রা করলে মাওয়া মহাসড়ক পেরিয়ে চোখে পড়ে এক নির্দেশক বোর্ড ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আর বেশি দূরে নয়’। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছানো যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাইরে থেকে শান্ত ও নিস্তব্ধ মনে হলেও ভেতরে এটি এক প্রাণচঞ্চল শিক্ষানগরী—যেখানে হাজারো তরুণ-তরুণী স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ গড়ার অভিযানে ব্যস্ত।
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের নবম বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী শিক্ষাবিস্তারের চেতনা থেকেই জন্ম নেয় এই প্রতিষ্ঠান। ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে রেখেছে এর রাজনীতিমুক্ত পরিবেশ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। ফলে শিক্ষার্থীরা নিরপেক্ষ, নিরাপদ ও সহাবস্থানমুখী এক একাডেমিক পরিবেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে। যেখানে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় সংঘাতের কারণে পাঠক্রম ব্যাহত হয়, সেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিপূর্ণ শিক্ষাজীবনের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
ময়ূর নদীর তীরে গল্লামারির ঐতিহাসিক ভূমিতে গড়ে ওঠা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এখন এক পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানগরী। ১০৬ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ক্যাম্পাসে রয়েছে আটটি স্কুল, ২৯টি ডিসিপ্লিন ও দুটি ইনস্টিটিউট। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, সমাজবিজ্ঞান, কলা, আইন, ব্যবসা প্রশাসন, জীবনবিজ্ঞান ও চারুকলা—সব শাখায় সমান গুরুত্বে চলছে জ্ঞানের চর্চা।
বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নিশ্চিতে আউটকাম-বেসড এডুকেশন (ওবিকিউ) পদ্ধতি অনুসরণ করছে। শিক্ষার্থীদের শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব দক্ষতা অর্জনের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) অবিরাম কাজ করছে একাডেমিক মান উন্নয়নে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শক্তি এর গবেষণা ও উদ্ভাবন। সুন্দরবন ও উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম সমন্বিত গবেষণা ইনস্টিটিউট। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম সয়েল আর্কাইভ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্তর্জাতিক জার্নালে ৫০০-এর বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা ও শিক্ষা বিনিময়ের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে একাধিক সমঝোতা স্মারক ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০০ শিক্ষক সাত হাজার শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষায় প্রস্তুত করছেন আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। শিক্ষকদের এক-তৃতীয়াংশ পিএইচডিধারী আর শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:১২, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আদর্শ।
আধুনিক স্মার্ট ক্লাসরুম, ইনোভেশন হাব, সেন্ট্রাল ল্যাব ও ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার স্নাতক এখান থেকে বেরিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাত, গবেষণা, গণমাধ্যম ও উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন দেশ-বিদেশে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানের কেন্দ্র নয়, এটি মানবিকতা ও আত্মত্যাগেরও প্রতীক। গণিত ডিসিপ্লিনের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ জুলাই বিপ্লবের সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ মীর মুগ্ধ তোরণ’। প্রতি বছর ১৮ জুলাই পালিত হয় ‘শহীদ মীর মুগ্ধ দিবস’, আর শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে চালু হয়েছে ‘শহীদ মীর মুগ্ধ বৃত্তি’।
বিশ্ব এখন গবেষণা, দক্ষতা ও উদ্ভাবনের যুগে প্রবেশ করেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে চলেছে সেই লক্ষ্যেই—রাজনীতিমুক্ত, জ্ঞাননির্ভর ও গবেষণামুখী এক শিক্ষাঙ্গন হিসেবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আজ শুধু একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি মুক্তচিন্তা, উদ্ভাবন ও প্রগতির প্রতীক—যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পেশাদার দক্ষতার পাশাপাশি মানবিকতা, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়।