১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছোটবেলা থেকেই বই ভালোবাসতেন। বই ছিল তার বন্ধু, আশ্রয় ও আনন্দ। সেই ভালোবাসাই একসময় তাকে নিয়ে যায় লেখালেখির জগতে। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা শিশুসাহিত্যিক।
আলী ইমামের বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক, যা সত্যিই এক বিস্ময়। শিশুকিশোরদের জন্য এত বিপুল পরিমাণে লেখা, তাও প্রতিটি বইয়ে নতুন ভাবনা, নতুন কল্পনা—এ যেন এক জীবনের সাধনা। তার গল্পে কখনো রহস্য, কখনো অভিযান, কখনো মমতা, কখনো বীরত্ব, কখনো দেশপ্রেম। শিশুদের মন তিনি বুঝতেন গভীরভাবে; জানতেন তারা কীভাবে হাসে, কীভাবে স্বপ্ন দেখে, কীভাবে ভয় পায় আর আবার সাহসী হয়ে ওঠে।
আলী ইমামের জনপ্রিয় বইগুলোর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, আর শেখার আনন্দ। কিন্তু শুধু আনন্দ নয়, আলী ইমামের গল্প ছোটদের শেখায় সত্যবাদিতা, পরিশ্রম, সাহস আর ভালোবাসা। তিনি বিশ্বাস করতেন, গল্প শুধু বিনোদন নয়, এটি চরিত্র গঠনের মাধ্যম।
তিনি শিশুদের শেখাতে চেয়েছেন কীভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। তার লেখায় নদী আছে, পাহাড় আছে, অরণ্যের ঘ্রাণ আছে; আছে পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ আর ফুলের রঙ। প্রকৃতি তার কাছে ছিল জীবনের পাঠশালা, যেখানে মানুষ শেখে বিনয়, শেখে সহমর্মিতা।
আলী ইমাম শিশুদের দেখিয়েছেন—শেখা মানেই আনন্দ, জানা মানেই অভিযাত্রা। তাই তার বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলোও হয়ে উঠেছে গল্পের মতো সহজ, মজার ও কৌতূহলোদ্দীপক।
বহু বছর তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও ও প্রকাশনা জগতে। তার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও সৃজনশীল দিকনির্দেশনায় তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিশুতোষ অনুষ্ঠান ও প্রকাশনা। তিনি তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতেন, বলতেন, ‘শিশুরা হলো ভবিষ্যতের নির্মাতা; তাদের কাছে সত্য ও সুন্দর পৌঁছে দাও, তারা নিজেরাই পথ চিনে নেবে।’
আলী ইমামের জীবন ছিল বিনয় ও নিষ্ঠায় ভরা। তিনি খ্যাতির চেয়ে দায়িত্বকেই বড় মনে করতেন। নিজের কাজ নিয়ে কখনো গর্ব করতেন না; বরং বলতেন, ‘আমি শুধু গল্প বলি, বাকিটা শিশুরা ঠিক করে নেয়।’ তার সেই সরল হৃদয়, মৃদু হাসি ও কোমল কণ্ঠ আজও মনে পড়ে যায় অনেকের।
২০২২ সালের ২১ নভেম্বর আলী ইমাম চলে গেছেন এ পৃথিবী থেকে চিরতরে; কিন্তু তার রেখে যাওয়া গল্পগুলো আজও শিশুদের হাসায়, কাঁদায়, নতুন কিছু সৃষ্টি করার কথা ভাবায়। তার চরিত্ররা আজও কথা বলে, দৌড়ে বেড়ায় শিশুদের কল্পনার দেশে। একজন সত্যিকারের শিশুসাহিত্যিকের মৃত্যুর পরেও তার সৃষ্টির মৃত্যু হয় নাÑআলী ইমাম সেই প্রমাণ রেখে গেছেন।
আলী ইমাম ছিলেন শিশুদের আপনজন, কল্পনার পথপ্রদর্শক। তার লেখা যতদিন ছোটদের হাতে হাতে ঘুরবে, যতদিন কোনো শিশু রাতের অন্ধকারে লণ্ঠনের আলোয় তার বই খুলে পড়বে, ততদিন আলী ইমাম বেঁচে থাকবেনÑপ্রতিটি শিশুর হাসিতে, প্রতিটি গল্পের হৃদয়ে।