প্রতিবছর নভেম্বর মাসকে বিশ্বব্যাপী ‘ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতা মাস (Lung Cancer Awareness Month)’ হিসেবে পালন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো—মানুষকে এই মারাত্মক রোগ সম্পর্কে সচেতন করা, প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয়ের গুরুত্ব বোঝানো এবং প্রতিরোধের পথে সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা।
বাংলাদেশেও প্রতি বছর নভেম্বর মাসে বিভিন্ন হাসপাতাল, চিকিৎসক সংগঠন ও গণমাধ্যমের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি পালিত হয়। কারণ ফুসফুস ক্যানসার আমাদের দেশেও দ্রুত বাড়ছে। এটি পুরুষদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ক্যানসার, তবে সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের মধ্যেও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফুসফুস ক্যানসার কী?
ফুসফুস ক্যানসার হলো ফুসফুসের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে টিউমারে পরিণত হয়। এই টিউমার ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, এমনকি শরীরের দূরবর্তী অংশেও।
মানবদেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজটি করে দুটি ফুসফুস। যখন এই অঙ্গে কোষের অস্বাভাবিক বিভাজন শুরু হয়, তখনই ফুসফুস ক্যানসার গঠিত হয়।
ধরন
নন-স্মল সেল লাং ক্যানসার (NSCLC) । প্রায় ৮৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এই ধরনটি দেখা যায়। এর মধ্যে তিনটি উপধরন রয়েছে—অ্যাডিনোকারসিনোমা, স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা ও লার্জ সেল কারসিনোমা।
স্মল সেল লাং ক্যানসার (SCLC)। তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এটি বেশি দেখা যায় অতিরিক্ত ধূমপায়ীদের মধ্যে।
কারণ
ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ হলো তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ। তবে আরো কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রয়েছে, যেমন—
ধূমপান : মোট ফুসফুস ক্যানসারের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ধূমপান দায়ী। সিগারেট, বিড়ি, পাইপ—সবই সমান ক্ষতিকর।
পরোক্ষ ধূমপান : নিজে না ধূমপান করলেও অন্যের ধোঁয়ায় নিয়মিত আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বৃদ্ধি পায়।
বায়ুদূষণ ও পেশাগত ঝুঁকি : কারখানা, গ্যাস, ধাতব ধূলিকণা বা অ্যাসবেস্টসের সংস্পর্শে থাকা শ্রমিকদের ফুসফুসে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।
জেনেটিক কারণ : পরিবারে আগে ফুসফুস ক্যানসার থাকলে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।
রেডন গ্যাস বা রেডিয়েশন : কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ রেডন গ্যাসের সংস্পর্শ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা : ফল-সবজি কম খাওয়া এবং ভাজাপোড়া ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি গ্রহণও ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গ
ফুসফুস ক্যানসার প্রাথমিক অবস্থায় প্রায় কোনো লক্ষণই প্রকাশ করে না। এজন্যই একে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। তবে এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত—১. দীর্ঘদিন ধরে শুকনো বা কফযুক্ত কাশি; ২. কফে রক্ত বা বাদামি দাগ; ৩. বুকে ব্যথা, বিশেষ করে গভীর শ্বাসে; ৪. শ্বাসকষ্ট, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া; ৫. অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্তি বা ওজন হ্রাস; ৬. খাবারে অরুচি, কণ্ঠ ভাঙা বা গিলতে কষ্ট; ৭. বারবার ফুসফুসের সংক্রমণ (যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া)।
প্রায়ই রোগীরা মনে করেন এটি শুধু সর্দি-কাশি বা ব্রঙ্কাইটিস, ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়।
রোগ নির্ণয় বা পরীক্ষা
রোগটি নিশ্চিতভাবে জানতে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। যেমন—
চেস্ট এক্স-রে : প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ে ব্যবহৃত হয়।
সিটি (CT) স্ক্যান : ফুসফুসের টিউমারের আকার ও অবস্থান নির্ণয় করে।
বায়োপসি : টিউমারের কোষ সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করা হয়।
ব্রঙ্কোস্কপি : একটি বিশেষ টিউব ফুসফুসে ঢুকিয়ে নমুনা নেওয়া হয়।
পিইটি স্ক্যান : ক্যানসার শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়েছে কিনা তা জানা যায়।
যদি কেউ দীর্ঘদিন ধূমপান করেন বা বয়স ৫০-এর বেশি হয়, তার ক্ষেত্রে বছরে একবার স্ক্রিনিং পরীক্ষা করানো উপকারী।
চিকিৎসা পদ্ধতি
ফুসফুস ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে ক্যানসারের ধরন, পর্যায় ও রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর। প্রধান চিকিৎসা হলো—
অস্ত্রোপচার (Surgery) : প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলা হয়।
কেমোথেরাপি : ক্যানসার কোষ ধ্বংস করার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়, যা শিরা বা মুখে গ্রহণ করা হয়।
রেডিয়েশন থেরাপি : উচ্চ ক্ষমতার বিকিরণ দিয়ে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি : নতুন যুগের চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে ক্যানসার কোষের নির্দিষ্ট জিন বা প্রোটিনকে লক্ষ করে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। বিশ্বের উন্নত দেশে এখন এসব আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা (personalized treatment) চালু হয়েছে।
ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়
ধূমপান সম্পূর্ণ বন্ধ করুন । এটি ত্যাগের কোনো বিকল্প নেই। ধূমপান ছাড়ার পর কয়েক বছরেই ফুসফুস অনেকাংশে সুস্থ হয়ে ওঠে। পরোক্ষ ধূমপান থেকে দূরে থাকুন। আপনার পরিবারে কেউ ধূমপান করলে তাকে বাইরে করতে বলুন। রাস্তার ধুলো ও ধোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে মাস্ক ব্যবহার করুন। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস—ফলমূল, সবজি, ভিটামিন এ, সি এবং ই-সমৃদ্ধ খাবার ফুসফুসের জন্য উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করুন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটলে বা ব্যায়াম করলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পেশাগত নিরাপত্তা বজায় রাখুন। কারখানায় কাজ করলে মাস্ক ও সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা জরুরি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি