ঋতু পরিবর্তন প্রকৃতিতে যেমন নতুনত্ব আনে, তেমনি মানুষের শরীর-মনেও বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটায়। শীতকাল সাধারণত অনেকের কাছে আরামদায়ক মনে হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ সময়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাপমাত্রা কমে গেলে বাতাস শুষ্ক হয়, রোগজীবাণুর বিস্তার বাড়ে এবং দেহকে উষ্ণ রাখতে বাড়তি শক্তি ব্যয় হয়। এসব শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে শীতকালে মন-মেজাজের ওঠানামা, একাকিত্ববোধ এবং বিষণ্ণতার লক্ষণ তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।
মানসিক অসুস্থতা
দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক নয়। গবেষণায় দেখা যায়—প্রতি আটজনের একজন কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের হার প্রায় ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শিশুদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। আরো দুঃখজনক হলো—এই বিপুলসংখ্যক রোগীর মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশই চিকিৎসার আওতার বাইরে রয়ে যান। নারীরা মানসিক সমস্যায় তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হলেও পুরুষরা সামাজিক সংকোচ বা ভুল ধারণার কারণে চিকিৎসা নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কিশোরদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ চিকিৎসা সুবিধা পান, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি। বিশ্বব্যাপীও মানসিক রোগ বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৯৭ কোটি মানুষ বিভিন্ন মানসিক রোগ বা মাদকাসক্তির সমস্যায় ভুগছেন। তাই মানসিক স্বাস্থ্যকে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। বরং এটি এখন জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
মানসিক রোগের কারণ
মানসিক রোগ কোনো একক কারণে তৈরি হয় না, বরং জটিল ও বহুস্তরীয় উপাদানের সম্মিলিত প্রভাব এতে কাজ করে। পরিবারে আগে মানসিক অসুস্থতার ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এটাকে জেনেটিক কারণ বলে। দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক রোগ যেমনÑহৃদরোগ, ক্যানসার, হরমোনজনিত রোগ বা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ার অভ্যাসও মানসিক শক্তি দুর্বল করে। অ্যালকোহল, ইয়াবা, গাঁজা, আইস—এসব নেশা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট করে মানসিক রোগ বাড়ায়। ট্রমা ও মস্তিষ্কে আঘাত যেমনÑশিশুকালে সহিংসতা, দুর্ঘটনা বা মানসিক ট্রমা দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক সমস্যা তৈরি করে। নিদ্রাহীনতা ও ক্রনিক স্ট্রেস। ব্যস্ত জীবনে ঘুমের অভাব, কর্মচাপ, উদ্বেগ ও হতাশা মানসিক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। পারিবারিক অস্থিরতা ও পরিবেশগত চাপ আরেকটি কারণ। পরিবারে বিচ্ছেদ, ঝগড়াঝাঁটি, অর্থনৈতিক সংকট বা একাকিত্বও মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
যে লক্ষণ দেখলে সতর্ক হবেন
মানসিক রোগের লক্ষণ সাধারণ আচরণগত পরিবর্তনের মতো মনে হলেও সময়মতো চিহ্নিত করা জরুরি।
আচরণ বা মেজাজে অকারণে পরিবর্তন
দীর্ঘদিন মন খারাপ বা বিষণ্ণতা
পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে ফেলা
সবকিছুতে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি
রাগ, উত্তেজনা বা অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি
গায়ে ধরা আওয়াজ শোনা অথবা অযৌক্তিক সন্দেহ
কাজের প্রতি অনীহা, মনোযোগের ঘাটতি
ব্যক্তিগত পরিচর্যা বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবহেলা
ঘুম ও খাওয়ার অভ্যাসে অস্বাভাবিক পরিবর্তন
এসব লক্ষণ দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
মানসিক রোগের ধরন
মানসিক রোগ সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত। নিউরোসিস এবং সাইকোসিস। তুলনামূলক হালকা সমস্যা, যেমন রোগী বাস্তবতা বুঝতে পারে এবং আশপাশের মানুষের জন্য বিপজ্জনক নয়। যথাসময়ে চিকিৎসায় দ্রুত উন্নতি হয়। এটি নিউরোসিস। আর গুরুতর মানসিক সমস্যা, যেমন রোগী বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যায় এবং নিজে বা অন্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া বা গুরুতর বিষণ্ণতা এর অন্তর্ভুক্ত। এটি সাইকোসিস।
মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি কেন?
শীতের দিনে সূর্যের আলো কম থাকে আর দিন ছোট হয়ে আসে। এই পরিবর্তন মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা সরাসরি মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অনেকেই শীতকালে হতাশা, মনমরা ভাব ও অস্থিরতায় ভোগেন। এই অবস্থাকে বলা হয়—
সিজনাল অ্যাফেকটিভ ডিজঅর্ডার (SAD)
অথবা মৌসুমি বিষণ্ণতা।
এ রোগের সাধারণ লক্ষণ—
অতিরিক্ত ক্লান্তি
বেশি ঘুমানোর প্রবণতা
ওজন বৃদ্ধি
কাজে অনাগ্রহ
মনোযোগের অভাব
একা থাকতে ইচ্ছা করা
অনেকের ক্ষেত্রে এটি হালকা আকারে দেখা যায়, যাকে ‘উইন্টার ব্লুজ’ বলা হয়।
মোকাবিলার কার্যকর উপায়
শীতকালে মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে কিছু সহজ অভ্যাস অত্যন্ত কার্যকর—
রোদে থাকা
প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট রোদে হাঁটাচলা করলে সেরোটোনিন বাড়ে ও মন ভালো থাকে।
লাইট থেরাপি
যেসব অঞ্চলে রোদ কম, সেখানে এটি অত্যন্ত উপকার।
নিয়মিত ব্যায়াম
রোজ ৩০ মিনিট ব্যায়াম মানসিক চাপ কমায়, শক্তি বাড়ায় এবং ঘুম ভালো করে।
ঘুমের নিয়ম ঠিক রাখা
নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ঘুম-জাগরণের অভ্যাস মানসিক স্থিতি উন্নত করে।
পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা
একাকিত্ব মানসিক রোগকে আরো বাড়ায়।
বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া
লক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলে দেরি করা উচিত নয়।
পরিশেষে বলতে চাই, মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এখনই। মানসিক অসুস্থতা কোনো দুর্বলতা নয়; বরং এটি চিকিৎসাযোগ্য একটি স্বাস্থ্যসমস্যা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ—কুসংস্কার দূর করা, রোগীর পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের চিকিৎসায় সহযোগিতা করাই মানসিক সুস্থতার মূলভিত্তি।
ব্যক্তিগত সচেতনতা, পারিবারিক সমর্থন এবং ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুললেই মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান
জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি