ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়েছে ‘আদি নববর্ষ’- নবান্ন উৎসবের ধারায় বাংলার প্রাচীন নববর্ষ উদযাপনের এক নতুন ও ঐতিহাসিক অধ্যায়।
অগ্রহায়ণের হিমেল রোদে, চারুকলা অনুষদের আকুলতায় রবিবার সকাল থেকে দিনব্যাপী বর্ণিল আয়োজন, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর দেশজ মোটিফে মুখর ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
ডাকসু ও বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্য নামক একটি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বাংলা পঞ্জিকার প্রাচীন ইতিহাস, কৃষিভিত্তিক জীবন ও লোকঐতিহ্যের ভাষ্যে সাজানো ছিল এই উৎসব।
হেমন্তের নরম রোদ, শিশিরভেজা ঘাস, আর চারদিকে সোনালি ধানের সুবাস মাখা অগ্রহায়ণের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ যেন পুনরায় ফিরে গেল বাংলার প্রাচীন গ্রামীণ জনপদে। দীর্ঘদিন ধরে বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন করলেও এ অঞ্চলে যে একসময় পহেলা অগ্রহায়ণই ছিল নববর্ষ- এই ভুলে যাওয়া ইতিহাস সামনে এনেই আজ প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো ‘আদি নববর্ষ’ উৎসব।
এদিন দুপুর ১২টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় ‘আদি নববর্ষ আনন্দযাত্রা’। শোভাযাত্রায় ছিল তিনটি প্রধান মোটিফ- '৩৬ জুলাই’ শিরোনামে একটি সময়-রাজনীতি সংশ্লিষ্ট শিল্পমোটিফ, জেলে জীবনের প্রতীকী উপস্থাপন, এবং কৃষিজীবনকে ফুটিয়ে তোলা একটি মনোগ্রাহী শিল্পকর্ম।
সঙ্গে পালকি, ধানের কুলা, গামছা-কাস্তে হাতে কৃষক, জাল ছোড়া জেলে, গ্রামীণ অলংকার- সব মিলিয়ে শোভাযাত্রাটি হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ দেশজ সংস্কৃতির এক মোহনীয় প্রদর্শনী।
এর আগে সকাল ১০টায় ‘রঙতুলিতে নবান্ন’ পর্বের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ মোট ১৫ জন শিল্পী জুলাই ও নবান্নকে কেন্দ্র করে আঁকেন একেকটি থিম্যাটিক চিত্রকর্ম। প্রত্যেক ক্যানভাসে ফুটে ওঠে হেমন্তের বাতাস, কৃষকের রোদ-ধরা মুখ, নতুন ধানের উজ্জ্বলতা, আর বাংলার তির্যক ইতিহাস।
এদিন বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। উপস্থিত ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ, এজিএস মু. মহিউদ্দিন খান। সভাপতিত্ব করেন ভিপি সাদিক কায়েম।
এরপর মঞ্চে পরিবেশিত হয় আবৃত্তি, গান, নাচ, জাদু, পালাগানসহ দেশজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বিপ্লবী সাংস্কৃতিক ঐক্যের সদস্য সংগঠনগুলোর শিল্পীরা পুরো চারুকলা চত্বরকে পরিণত করেন উৎসবমুখর এক সাংস্কৃতিক মেলায়।
অগ্রহায়ণের শুরুতে নববর্ষ উদযাপনের ডাকসুর সিদ্ধান্তকে ঘিরে গতকাল থেকেই ক্যাম্পাসে আলোচনা-সমালোচনা চলছিল।
কেন বৈশাখ ছাড়াও ‘আদি নববর্ষ’- এই প্রশ্নের উত্তরে ডাকসুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন,
“প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষ ছিল অগ্রহায়ণে। নবান্নই ছিল বাঙালির আদি নববর্ষ উদযাপন, যা কৃষক সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। বৈশাখকে নববর্ষ করা হয় সম্রাট আকবরের আমলে প্রশাসনিক কারণে। আমাদের উদ্দেশ্য ইতিহাসকে স্মরণ করানো, বৈশাখকে প্রতিস্থাপন নয়।”
তিনি আরও জানান, ডাকসু বৈশাখেও নববর্ষ উদযাপন করবে। তবে অগ্রহায়ণের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতেই এই নতুন উৎসব।
হেমন্তের প্রকৃতি, নতুন ধান, নবান্ন, গৃহস্থের আনন্দ- সব মিলিয়ে এই সময়টি আদিকাল থেকে ছিল কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনের প্রধানতম উৎসব।
মূলত, ‘অগ্র’ মানে প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে মাস- তাই অগ্রহায়ণই ছিল বছরের শুরু। সেইদিনেই পালিত হতো আমানি উৎসব, নতুন অন্ন দেবতা ও পূর্বপুরুষদের নিবেদন, কুল-আত্মীয়দের মাঝে অন্নবিতরণ, নতুন চালের পিঠা-পুলির মেলা।