বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে অকার্যকর অবস্থায় আছে। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায় ও প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং নেতৃত্ব বিকাশের এই গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম পুনরায় চালুর দাবিতে এবার সরব হয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে সৎ, মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে বাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এর পর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। প্রায় তিন দশক ধরে ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির প্ল্যাটফর্মটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে।
বাকসু পুনর্গঠনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘বাকসু ডায়ালগ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গত ২৬ অক্টোবর বাকসু নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বাকসু ভবনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ব্যতিক্রমী একটি ব্যানার ‘সেন্ট্রাল ভাতের হোটেল’।
ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি তুলে ধরার এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একমাত্র প্ল্যাটফর্ম হতে পারে বাকসু। ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য দ্রুত বাকসু নির্বাচন দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি বাকসুর ব্যবস্থা না করে, তাহলে তারা ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। উপাচার্যের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই—আমাদের বাকসু আইনকে সমুন্নত রাখার জন্য হলেও নির্বাচন দিতে হবে। দেশের কৃষি সেক্টরে নেতৃত্ব দিতে এবং নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে এটি প্রয়োজন। অধিকার আদায় করে নিতে হয়; বাকসু না দিলে আমরা তা আদায় করে নেব।
কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী সানাউল্লাহ বলেন, বিগত ২৭ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক কথা বলবে এমন কোনো নেতৃত্ব আমরা পাইনি। যারা এসেছে, তারা সরকারের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে এসেছে। এতে যখন কেউ ক্যাম্পাস বা দেশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন সে সুরক্ষিত থাকে না, কারণ তারা নিয়ন্ত্রিত। এসব থেকে মুক্তি পেতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বাকসু নির্বাচনের জন্য জোরাল দাবি তোলা উচিত।
পশুপালন অনুষদের শিক্ষার্থী শিবলী সাদি বলেন, সেমিস্টার ফর্ম ফিলআপ ফি দেওয়ার সময় আমাদের কাছ থেকে বাস কার্ড ফি, ছাত্র সংসদ ফি ও ওয়াইফাই বিল নেওয়া হয়, কিন্তু আমরা কোনো সুবিধা কার্যকরভাবে পাচ্ছি না। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের কোনো বৈধ প্ল্যাটফর্ম নেই। সেই বৈধ প্ল্যাটফর্মই হচ্ছে বাকসু। প্রশাসনের কাছে শুধু স্মারকলিপি দিলেই হবে না, প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুততম সময়ে।
কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের শিক্ষার্থী জাবিন তাসনিম বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। নানা আন্দোলন ও দাবির পরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি, অপরাধের বিচারও হয় না বা ধীরগতিতে হয়। যদি ছাত্র সংসদ থাকত, এসব সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হতো। নারী শিক্ষার্থীরা এককভাবে কিংবা দলগতভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, কিন্তু প্রতিনিধিত্বের অভাবে এসব ঘটনা অনেক সময় প্রকাশই পায় না। তাই নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ছাত্র সংসদ পুনরায় চালু করা জরুরি।
বাকৃবি দ্বীনি কমিউনিটির মারুফ বিল্লাহ বলেন, আমরা কোনো বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের কাছে গেলে তারা প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন ‘তুমি কে?’ এজন্য আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ জরুরি, আর এজন্যই বাকসু দরকার। শিক্ষার্থীদের সমর্থন নিয়ে যখন কেউ কথা বলবে, তখন তার কথার ভেতর আলাদা শক্তি থাকবে, যা দিয়ে আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে আমাদের যৌক্তিক দাবি আদায় করতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি-নির্ধারণ শিক্ষকরা করেন, কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা তারা অনেক সময় বুঝতে পারেন না। আমরা যদি নিজেরাই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তুলে ধরতে পারি, সমাধানও দ্রুত আসবে।
পশু পুষ্টি বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ও বাকৃবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু নাসের ত্বোহা বলেন, নিরাপত্তা শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমাদের বোনদেরও যদি রাস্তায় নেমে নিরাপত্তা দাবি করতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু হতে পারে না। বহিরাগতদের হামলায় প্রশাসনের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে খাবার খাচ্ছে তা পুষ্টিহীনতার প্রতিচ্ছবি, অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই হওয়া উচিত দেশের পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তার অগ্রদূত। তাই শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার আদায়ে কার্যকর বাকসু গঠন এখন সময়ের দাবি।
বাকৃবি ছাত্রদলের সদস্যসচিব শফিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদল বাকসুর দাবিতে সর্বপ্রথম ২৪ ফেব্রুয়ারি সমাবর্তন চত্বরে সমাবেশ করে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। সম্প্রতি কম্বাইন্ড ডিগ্রির দাবিতে একাডেমিক কার্যক্রম প্রায় ৩৪ দিন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে। বাকসু অবশ্যই হতে হবে, তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত হলে সেটি সবার জন্যই উত্তম হবে।