হোম > সাহিত্য সাময়িকী

তাইরান : সাহিত্যের চেয়ে বেশি

মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে লিটল ম্যাগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল বিচিত্র ও বহুভাষিক। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এর বিস্তার ঘটে। বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’-কে (১৯১৪) যথার্থ অর্থে প্রথম আধুনিক লিটল ম্যাগাজিন বলা হয়, যা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তন করে সাহিত্যের খোলস বদলে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্র-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি ও পূর্বাশা’র মতো পত্রিকাগুলো এক নতুন যুগের সূচনা করে। এই ধারায় ১৯২৭ সালে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত ‘শিখা’ পত্রিকার ভূমিকা ছিল অসামান্য। ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’Ñএই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শিখা পত্রিকাটি মুসলিম সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনেছিল এবং মুক্তচিন্তার পথ প্রশস্ত করেছিল।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন এক নতুন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রা লাভ করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, এই ছোট কাগজগুলো বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জাতীয়তাবাদী উন্মেষের প্রধান বাহন ছিল। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সীমান্ত’ কিংবা পরবর্তী সময়ে ষাট ও সত্তর দশকের বিভিন্ন পত্রিকা কেবল সাহিত্যচর্চা করেনি, বরং স্বৈরাচার ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে বিশেষত নব্বইয়ের দশকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের এক বিপুল জোয়ার দেখা যায়। এই সময়ে লোকায়ত, একবিংশ, প্রান্তর, নদী ও নির্মাণ-এর মতো পত্রিকাগুলো ঢাকা ও মফস্বল থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়ে সাহিত্যের বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখে। যদিও পুঁজির অভাব ও বিপণন সমস্যার কারণে অনেক উদ্যোগই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবুও ‘কালি ও কলম’, ‘শব্দঘর’, ‘নতুন এক দিগন্ত’, ‘প্রেক্ষণ’ কিংবা ‘নতুন এক মাত্রা’র মতো পত্রিকাগুলো বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য ও চিন্তার জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। এদের কেউ ইতিহাসের সন্ধানে, কেউ আধুনিকতায়, আবার কেউবা নন্দনতাত্ত্বিক পরীক্ষায় নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে।

তবে আশির দশকে প্রকাশিত ‘কিশোধ্বনি’, মোশাররফ হোসেন খান সম্পাদিত ‘নতুন কলম’, এবং একই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘নোঙর’, জাফর তালুকদার সম্পাদিত ‘গল্প’ নামক বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। এটি ছোটগল্প বিষয়ক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ছিল। এছাড়া তিনি ‘অক্ষর’ (খুলনা থেকে) এবং ‘ক্রান্তি’ (ঢাকা থেকে) নামক সাহিত্যপত্রিকাও সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন। আতা সরকার কৈশোরে ‘প্রভা’ নামক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন (যা আইয়ুব সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল)। পরবর্তী সময়ে তিনি ‘সারথি’ (ছাত্রজীবনে), কিশোর পত্রিকা ‘পল্লব’ এবং ‘প্রবন্ধপত্র’ নামক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন। এছাড়া ইশারফ হোসেন সম্পাদিত ‘সকাল’, যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দাবানল’, আবদুল হাঁলীম খাঁ সম্পাদিত ‘রেনেসাঁ’, মতিউর রহমান মল্লিক সম্পাতি ‘বিপরীত উচ্চারণ’, এবং ‘বিপরীত উচ্চারণ’, ‘খেয়া’, ‘ঊষালোক’, ‘সারণী’, ‘স্রোত’, নাজিব ওয়াদুদ সম্পাদিত ‘সিঁড়ি’ উল্লেখযোগ্য।

এই দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে সমকালীন বাংলাদেশে ‘তাইরান’ নামের ছোট কাগজটি এক নতুন প্রতিশ্রুতির বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তাইরান কেবল একটি সাহিত্যপত্র নয়, এটি এমন এক মুক্তমনা প্রয়াস, যা বিশ্বসাহিত্যের বিশাল সমুদ্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় দর্শন অত্যন্ত স্পষ্ট ও আপসহীন। কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা করপোরেট পুঁজির কাছে হাত না পেতে, সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ও সম্পাদনা পরিষদের শ্রমে এটি প্রকাশিত হয়। সম্পাদকের ভাষায়, ‘হাত পাতিনি আমরা। হাত পেতে স্বকীয়তার প্রশ্ন তোলার সুযোগও করে দিতে চাই না।’ এই মেরুদণ্ড সোজা রাখার অঙ্গীকারই তাইরানকে সমসাময়িক অনেক প্রকাশনা থেকে আলাদা করেছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ার তাৎক্ষণিক সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে গা না ভাসিয়ে ধীরস্থির ও গভীর মননশীলতার চর্চায় বিশ্বাসী।

তাইরানের বিষয়বস্তু ও বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি সাহিত্যের সীমানা পেরিয়ে দর্শন, ইতিহাস ও রাজনীতির জটিল তাত্ত্বিক আলোচনাতেও সমান আগ্রহী। প্লেটো, অ্যারিস্টটল কিংবা কান্টের নন্দনতত্ত্ব থেকে শুরু করে হাইডেগার ও ফুকোর মতো দার্শনিকদের চিন্তা এবং অস্তিত্ববাদ নিয়ে গভীর প্রবন্ধ এখানে স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে পত্রিকাটি মোগল ইতিহাস, বারো ভূঁইয়াদের বীরত্বগাথা এবং নজরুল-ইকবাল-সিরাজীর সাহিত্যকর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছে। বিশেষত ফারসি সাহিত্যের ধ্রুপদী ধারা এবং ইসলামি জ্ঞানকাণ্ডের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির যে ঐতিহাসিক যোগসূত্র, তা পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা তাইরানের পাতায় লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনেও পত্রিকাটি পিছিয়ে নেই; শেক্সপিয়রের ওথেলো থেকে শুরু করে সমকালীন চীনা কবিতা কিংবা আফ্রিকান সাহিত্যের অনুবাদ ও আলোচনা এর পরিসরকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও তাইরান অত্যন্ত সচেতন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জুলাই বিপ্লব, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য এবং ছাত্র-জনতার জাগরণের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিশ্লেষণ পত্রিকাটিকে সময়ের দলিল হিসেবে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ব্রেখট বা বোয়ালের থিয়েটার তত্ত্ব এবং সমাজ পরিবর্তনে নাটকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এটি প্রমাণ করেছে যে, লিটল ম্যাগাজিন কেবল বিনোদন নয়, বরং শিক্ষার মাধ্যম এবং সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। তবে এই সাহসী যাত্রার পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়। লিটল ম্যাগাজিনের চিরন্তন সমস্যা হলো অর্থসংকট। বিজ্ঞাপন বা রাজনৈতিক অনুদান ছাড়া মানসম্পন্ন প্রকাশনা চালিয়ে যাওয়া একটি কঠিন সংগ্রাম। তাছাড়া তাইরানের উচ্চমার্গীয় তাত্ত্বিক আলোচনা ও শৈল্পিক ভাষা অনেক সময় সাধারণ পাঠকের জন্য দুর্বোধ্য হয়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি করে।

তথাপি এই সীমাবদ্ধতাগুলোই আবার এর শক্তির উৎস, কারণ এটি আপামর জনতার সস্তা বিনোদনের জন্য নয়, বরং সিরিয়াস পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্যই নিবেদিত।

৩৬ জুলাই ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (শেষ পর্ব)

জুতো

সামাজিক ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের উপাখ্যান

খারাপ বই নিয়ে কথা বলা ভালো বইগুলোর মতোই আকর্ষণীয়

উপন্যাস : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ

৩৬ জুলাই: ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (১ম পর্ব)

তরুণ কবি এমদাদ হোসেনের নতুন বই ‘বেদনার দুর্দিনে তুমি আমার প্রার্থনা হও’

‘আবদুল্লাহ্‌’ ও বাঙালি মুসলমান সমাজ

নীল সমুদ্র, প্রাচীন প্রাসাদ আর রঙিন মানুষের গল্প

লেইস ফিতা ও জাদুর বাক্স