হোম > সাহিত্য সাময়িকী

৩৬ জুলাই ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (শেষ পর্ব)

এবাদুর রহমান

৩৬ জুলাই কী?

বর্ষাবিপ্লব শুধু একটা রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি এক প্রচণ্ড ঐতিহ্যবাদী অভ্যুত্থান, যা লিব্র্যাল উদার আধুনিকতার ভাষায় ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ বা ‘স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদ’ বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এর তিন মৌলিক চরিত্র এটিকে আলাদা কইরা দেয়।

প্রথমত, সামষ্টিক রুহানি জাগরণ, যা হাইডেগারের মিটজাইনের মতো হলেও ধর্মনিরপেক্ষ সমতল সংহতি নয়, বরং এক উল্লম্ব পারলৌকিক সংযোগ যা জীবিত-মৃত, বর্তমান-অতীত, ইহলৌকিক-পারলৌকিককে সংযুক্ত করসে।

দ্বিতীয়ত, শাহাদাত-প্রস্তুতি, যা জর্জিও আগাম্বেনের হোমো সাকের ধারণার বিপরীতে আবু সাঈদের প্রসারিত হাতে যাপিত হইসে; এই যাপন সর্বজনীন আত্মসমর্পণ ও একই সঙ্গে অনমনীয় প্রতিরোধের প্রতীক, যা অন্তিমে হইয়া উঠল চূড়ান্ত প্রতিরোধ এবং যা আমাদের মনসুন অভ্যুত্থানকে রুহানি উন্মেষে পরিণত করসে।

তৃতীয়ত, তার আর্কিপেলাগিক বা চিন্তার দ্বীপমালাসদৃশ গঠন, যা এডুয়ার গ্লিসঁর চিন্তার মডেল অনুসারে, চিন্তা ও প্রতিরোধের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে এক অদৃশ্য সিলসিলায় বাঁধে; দুনিয়াজোড়া ঐতিহ্যবাদী আন্দোলনের এই গঠনই, খোদার দুনিয়ায়, নয়া উদারবাদের মৃত্যুঘণ্টা বাজাইয়া আমেরিকান শতাব্দী ও আধিপত্যের শেষ প্রহর ঘোষণা করসে।

এখন, বিপ্লবীরা দাবি করতেসেন, পশ্চিমের জ্ঞানোদয় থেকে বাহির হয়ে আসা ধর্মনিরপেক্ষতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, প্রগতি ও সর্বজনীনতার একচেটিয়া মানদণ্ড এবং বিশ্বায়নের কফিনে শেষ পেরেক বসবে। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন জাতিগত ঐতিহ্য, ধর্ম এবং তালাল আসাদ যাকে বলেন কথোপকথনমূলক তুরাছ—তাই-ই হবে নূতন সময়ের দিশারি, পথপ্রদর্শক।

বিশ্ব রাজনীতিতে ঐতিহ্যবাদী মোড় নিজের উপস্থিতি এই বিজয়ে আনুষ্ঠানিক করসে এবং আমরা বলতেসি, এই ঐতিহ্যবাদী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে মুসলিম উম্মাহ, ইনশাআল্লাহ।

এই ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব চাইনিজ হান ও আরবদের পরে জগতের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি মহাজাতির উত্থানপর্বের সূচনাও কি তাহলে রচনা করে নাই? অবশ্য এই ঐতিহ্যবাদী মোড়ের প্রেক্ষাপট তৈরি হইতেসে এই শতাব্দীর শুরু থেকেই। কিন্তু আমাদের যে এই নূতনের উদ্বোধন হইল, তাকে বালেগ করার কাবিলিয়ত কোথায় লাশতান্ত্রিকদের কাছে? নফস-এ-জিহাদের কালিমাতুল হিকমাহ কোথায় তাদের শাহওয়াতে ক্ষয়ে যাওয়া আঙুলে? মুমলিকাত-এ-খুদাদাতকে পথ দেখাবার পিলসুজ কোথায় লাশতান্ত্রিকদের অশিক্ষিত, অপরিশীলিত ও অসংলগ্ন অভিজ্ঞানে?

৩৬ জুলাই : আধুনিকতার একচেটিয়া দাবির প্রত্যাখ্যান এবং উৎসের দিকে ফিরে যাওয়া এক সৃজনশীল পুনরুদ্ধার, যা ঐতিহ্যকে পুনরায় সক্রিয় করে।

৩৬ জুলাই : এক খাঁটি রুহানী উন্মেষ, যা শাহবাগের ‘রাজাকার’/‘যুদ্ধাপরাধী’ শ্রেণীকরণ অতিক্রম করে ঐতিহাসিক সত্যের দিকে ফিরে আসে।

কেন ৩৬ জুলাই?

১৯৪৭-১৯৭১, যাকে আমরা প্রায়ই বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক চেতনার শিখর মনে করি, কিন্তু আসলে ১৯৪৭-১৯৭১ কি ছিল না আমাদের মূল সিলসিলা থেকে এক বিচ্যুতি? মুসলিম কীভাবে বাঙালি হতে পারে? ভারতীয় উপমহাদেশের জগৎদৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমের রাজনৈতিক অন্টোলজি ও সত্তা কী?

এক জাতি তত্ত্বের সঙ্গে বাঙালি মুসলিমের বিশেষ পরিচয়ের সম্পর্ক কী? এই প্রশ্নগুলো পাকিস্তান কাঠামোতে সমাধান-অযোগ্য ছিল, কারণ পাকিস্তান প্রকল্প ছিল এক ঔপনিবেশিক সমাধান একদেশীয় সমস্যার জন্য।

পাকিস্তান প্রকল্পের তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব ছিল। প্রথমত, ধর্মীয় সর্বজনীনতা বনাম জাতিগত বিশেষত্ব (জিন্নাহর ১১ আগস্ট ১৯৪৭ ভাষণে উদার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’-এর অসংগতি);

দ্বিতীয়ত, ওয়েস্টফ্যালিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থা বনাম ইসলামি রাজনৈতিক সত্তাতত্ত্ব (তালাল আসাদের ধর্মনিরপেক্ষতার গঠনসমূহের মতো, যেখানে দীন প্রকাশ্য-ব্যক্তিগতকে আলাদা করে না)।

তৃতীয়ত, উর্দু সাম্রাজ্যবাদ যা বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয় হত্যার চেষ্টা।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান—বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এ সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে মুসলিমবিরোধী হিন্দু জাগরণ হিসেবে উপস্থাপন, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ (১৯২৩), যেখানে মুসলমান ‘বিদেশি’, গোলওয়ালকরের ‘আমরা অথবা আমাদের জাতিত্ব সংজ্ঞায়িত’ (১৯৩৯)-এ হিটলারের ইহুদি নির্মূলকে উদাহরণ—এইসব হেগেলের প্রভু-দাস দ্বান্দ্বিকতার একতরফা রূপ, যা মুসলমানকে ‘অপর’ বানাইয়া হিন্দু আত্মচেতনা গড়সে। কংগ্রেসের ‘অসাম্প্রদায়িক’ ১৯২৮-এর নেহরু রিপোর্টে মুসলিমদের জন্য কোনো পৃথক নির্বাচন বা আসন সংরক্ষণ না দিয়ে ১৯৩৭-এর নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে যৌথ সরকার গঠন না করে, বন্দেমাতরম জোর করে গাইতে বাধ্য করে—এসব মুসলিমদের ওপর ঘটসে।

শেরে বাংলা ফজলুল হক নেহরুকে সতর্ক করসিলেন—‘কংগ্রেসের নীতির দরুণ এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হইসে যেখানে হিন্দুরা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চাইতেসে।’ ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ (বহুবচন) থেকে জিন্নাহর একবচনকরণে প্রথম বিশ্বাসঘাতকতার বীজ রোপিত হইসে, যা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রমাণিত হইসে।

এই থিসিসের তাত্ত্বিক ব্রেক থ্রু

এই থিসিস প্রথমবার ৩৬ জুলাইকে তত্ত্বায়িত করতেসে, এবং বাঙালি মুসলিমের সত্তাতত্ত্ব ও আকারকে প্রকাশ করতেসে, যেখানে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ কোনো শিখর নয়, বরং মূল ঐতিহ্যবাদী সিলসিলার এক বিচ্যুতি; এই থিসিস আমাদের ইতিহাসবোধকে পুনর্নির্মাণ করে, শাহবাগের মতো ধর্মনিরপেক্ষ-জাতীয়তাবাদী কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে, যা ১৯৭১-কে দলীয় রাজনীতিতে হাইজ্যাক করসে।

এই তত্ত্বায়ন কীভাবে করতেসি?

সাতটি দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মূল তাত্ত্বিক পাটাতন, যার মধ্যে হেগেল, রনে গেনোঁ, ফুকো এবং হাইডেগার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, হেগেলের চেতনার বর্ণনাতত্ত্বের দ্বান্দ্বিক উল্লম্ফন দিয়ে স্লোগানের উল্টোনো—‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’—ব্যাখ্যা, যা দাসকে প্রভু বানাইসে।

দ্বিতীয়ত, হাইডেগারের ডাজাইন ও মিটজাইন দিয়ে সামষ্টিক জাগরণের সত্তাতাত্ত্বিক গভীরতা উন্মোচন, যা লাখো মানুষকে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে রাস্তা কাঁপাতে উদ্বুদ্ধ করসে।

তৃতীয়ত, ফুকোর বিষয়সমূহের ব্যবস্থার জ্ঞানমীমাংসা দিয়ে উদার-ফ্যাসিবাদী আধুনিকতার পুরোনো দৃষ্টান্তকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া।

চতুর্থত, তালাল আসাদের ধর্মনিরপেক্ষতার গঠনসমূহের কথোপকথনমূলক তুরাছ দিয়ে ঐতিহ্যের জীবন্ত কথোপকথন, যা ইসলামি বিশ্বজনীনতা ও স্থানীয় বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক গঠনকে পুনর্বিন্যাস করে দেওয়া।

পঞ্চমত, আগাম্বেনের হোমো সাকের ও লাশতান্ত্রিক মৃত্যুরাজনীতি দিয়ে মৃত্যুর সার্বভৌমত্ব, যা আশিল মেম্বের লাশতান্ত্রিক মৃত্যুরাজনীতির মতো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিঃশেষযোগ্য জীবনকে চ্যালেঞ্জ করসে।

ষষ্ঠত, কুনের দৃষ্টান্ত পরিবর্তন দিয়ে সভ্যতাগত ছেদবিন্দু, যা প্রস্তর যুগের শেষ ও ধাতু যুগের সূচনা চিহ্নিত করসে।

এবং সপ্তমত, রনে গেনোঁর ঐতিহ্যবাদ দিয়ে আধুনিকতার প্রত্যাখ্যান, যা শাহাব আহমেদের ‘ইসলাম কি?’-এর মতো ইসলামকে এক অর্থপূর্ণ প্রত্যাদেশের ধারণার সঙ্গে সংলাপ হিসেবে দেখায়।

এই বর্গমুদ্রা ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো আমরা ব্যবহার করসি শুধু তাদের ভাষায় নয়, বাংলা ভাষায়, বাঙালি মুসলিম চিন্তা ও যাপনের প্রেক্ষণীতে এনে ।

কেন এত আয়োজন করতে হইল? লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন আমাদের সতর্ক করে দিসিলেন যে, ‘আমার ভাষার সীমা হইতেসে আমার জগতের সীমা’ আমরা চাই নাই উদারনৈতিক লিব্র্যালিজমের তাত্ত্বিকতার অর্গলে গ্রেপ্তার হয়ে যেতে। বা ৩৬ জুলাইকে উদারনৈতিক লিব্র্যালিজমের ভাষায় বোধগম্য করতে গিয়ে ওই মাপে এই প্রচণ্ড, উচ্ছ্বাসী, সন্ত্রাসী ও অনৈতিহাসিক ঘটনাকে কেটে ছোট করে ফেলতে। আমাদের ৩৬ জুলাইকে বুঝতে ততটুকু ভাষাকে বিস্তৃত করতে হইসে, যতটুক হইলে আমাদের ভাষার সীমা আমাদের উদারনৈতিক লিব্র্যাল জগতের সীমা হয়েই ফুরিয়ে না যায়।

কেন তত্ত্বায়ন করতেসি?

কারণ যে ভাষায় আমরা এক ঘটনা বর্ণনা করি, সেই ভাষাই নির্ধারণ করে আমরা কী দেখি এবং কী দেখি না। ৩৬ জুলাই বুঝতে উদারনৈতিক লিব্র্যাল বর্ণনামূলক বিবরণ ও ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়; কারণ, এটি শুধু বাস্তবতার উপরিতলের ঘটনা ধরে, কিন্তু তার গভীরতা ক্যাপচার করতে পারে না ।

আমরা তত্ত্বায়ন করতেসি বর্ণনা থেকে নির্দেশনার দিকে যাত্রা করতে—এক নূতন ভাষা তৈরি করে, যা ৩৬ জুলাইয়ের প্রকৃত চরিত্র ধরবে এবং ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।

এটি এক কঠোর কিন্তু প্রোথিত প্রক্রিয়া, যা আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়ে নিবেদিত। আমরা এই অভ্যুত্থানকে অধস্তন ইতিহাস রচনার লেন্সে দেখতেসি, যাতে তার রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব উন্মোচিত হয়।

এই তত্ত্বায়নের মূলে রইসে সময়ের রাজনীতি বা ক্রোনোপোলিটিক্স, যা বিশেষ করে আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক।

ওয়াল্টার বেনজামিনের ‘সহিংসতার সমালোচনা’য় পৌরাণিক সহিংসতা—আইন-প্রতিষ্ঠার সহিংসতা—ঐশ্বরিক সহিংসতা—আইনবিনাশী সহিংসতা—এর ধারণা মনে করায় যে, ৩৬ জুলাই ছিল এক আইনবিনাশী সহিংসতা, যা পূর্ববর্তী ঔপনিবেশিক এবং ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের পৌরাণিক সহিংসতাকে প্রতিরোধ করে এক নূতন আইন ও রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা করসে।

কেন আমরা তা আর্টিকুলেট ও তত্ত্বায়িত করব না?

এক অর্থে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, কিন্তু সেই নূতন রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে আইন প্রয়োগ করতেসে; এটি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং এক রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিচার। আমাদের এই প্যাক-কাদার গাঙ্গেয় বদ্বীপে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হইসে বিজয়ী জনতার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং ইনসাফের আকাঙ্ক্ষা থেকে।

(লেখাটি ‘৩৬ জুলাই: ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি’ পাণ্ডুলিপির ভূমিকা থেকে নির্বাচিত)

তাইরান : সাহিত্যের চেয়ে বেশি

জুতো

সামাজিক ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের উপাখ্যান

খারাপ বই নিয়ে কথা বলা ভালো বইগুলোর মতোই আকর্ষণীয়

উপন্যাস : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ

৩৬ জুলাই: ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (১ম পর্ব)

তরুণ কবি এমদাদ হোসেনের নতুন বই ‘বেদনার দুর্দিনে তুমি আমার প্রার্থনা হও’

‘আবদুল্লাহ্‌’ ও বাঙালি মুসলমান সমাজ

নীল সমুদ্র, প্রাচীন প্রাসাদ আর রঙিন মানুষের গল্প

লেইস ফিতা ও জাদুর বাক্স