হোম > সাহিত্য সাময়িকী

নীল সমুদ্র, প্রাচীন প্রাসাদ আর রঙিন মানুষের গল্প

ইস্তাম্বুলে তিন দিন

মো. সাখাওয়াৎ হোসেন

ইস্তাম্বুল—এক শহর যেখানে একই দিনে ইউরোপে হাঁটা যায়, আবার ফেরি ধরে মিনিট কয়েকের ভেতর এশিয়ায় পৌঁছানো যায়। ইতিহাস, সংস্কৃতি, রন্ধনশৈলী আর মানুষের আতিথেয়তায় এই শহর যেন এক চিরপুরাতন রূপকথা, যা প্রতিবারই নতুন লাগে। আমার মনে ছিল বহু দিনের ইচ্ছে—একবার ইস্তাম্বুলে গিয়ে দাঁড়াব বসফরাসের তীরে, আর সূর্যাস্তের রঙে শহরটাকে নিজের চোখে দেখব। অবশেষে সেই সুযোগ এসে গেল। তিন দিনের জন্য উড়াল দিলাম ‘দুই মহাদেশের শহর’—ইস্তাম্বুলে।

প্রথম দিন : সুলতানাহমেতের ইতিহাসের ছায়ায়

ইস্তাম্বুল আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে প্লেন নামার পর প্রথম যে জিনিসটি আমাকে ছুঁলো, তা হলো শহরের সুগন্ধ। হালকা সমুদ্রের বাতাসের সঙ্গে কফির সুগন্ধ মিশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে, যেন শহর নিজেই আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। হোটেল ছিল সুলতানাহমেত এলাকায়—পুরোনো সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। সরু পাথুরে রাস্তা, লাল-বাদামি ইটের পুরোনো অট্টালিকা আর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সীগাল পাখির ডাক যেন সময়কে কয়েকশ বছর পিছিয়ে দিল।

নীল মসজিদের নীল আলো

চেক-ইন করে ব্যাগ রেখে প্রথমে ছুটলাম ব্লু মস্কের দিকে। যতই ছবি দেখেছি, বাস্তবে দেখার অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশাল প্রাঙ্গণ পেরিয়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম, তখন ভেতরের নীল টাইলসের আলো-ছায়া আমার চোখে এক মায়াবী ছাপ ফেলল। পুরো ঘর যেন নীলচে এক নরম আলোয় ভাসছে। কয়েকজন পর্যটক নিঃশব্দে ছবি তুলছে, কেউ আবার নরম গালিচায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—তারপরও জায়গাটায় ভীষণ শান্তি! মনে হলো যেন সময় এখানে থমকে আছে।

হায়া সোফিয়া : দুই ধর্মের মিলনস্থল

ব্লু মস্ক থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটা পথ হায়া সোফিয়া। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের স্থাপত্য, পরবর্তী সময়ে মসজিদে রূপান্তর, আবার আজ মিউজিয়াম—ইতিহাসে এর মতো পরিবর্তনের সাক্ষী খুব কম জায়গাই আছে। এর বিশাল গম্বুজ আর স্বর্ণালি মোজাইক দেয়াল দেখে বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মানুষের ভিড় ছিল, কিন্তু সবাই এক ধরনের নীরব শ্রদ্ধায় মগ্ন। মনে হলো এই ভবনটি শুধু ইতিহাস নয়, বরং মানুষের বিশ্বাসের বহু শতাব্দীর স্মৃতি ধারণ করে আছে।

হায়া সোফিয়ার সামনে বসে খেলাম সিমিত—তুর্কি গোলাকার পাউরুটি। অদ্ভুতভাবে নরম, তিলের ঘ্রাণে ভরপুর। সেইসঙ্গে এক কাপ তুর্কি চা—গাঢ় লাল রঙের, স্বাদে তীব্র। এই ছোট্ট খাবারের মধ্যেই যেন ইস্তাম্বুলের আত্মা লুকিয়ে ছিল।

গ্র্যান্ড বাজার : দরদাম আর বিস্ময়ের রাজ্য

দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম গ্র্যান্ড বাজারে। এ যেন এক সীমাহীন গোলকধাঁধা—প্রতিটি মোড়ে দোকান, প্রতিটি দোকানে রঙিন কার্পেট, সোনার অলংকার, মসলা, সিরামিক ও লণ্ঠন। দোকানদাররা হাসিমুখে ডাকছে—‘মাই ফ্রেন্ড, কাম হিয়ার! বেস্ট প্রাইস!’ আমি একটি নীল-সাদা চোখ আকৃতির আংটি কিনতে চাইলাম। দাম চাইল হাজার লিরা; আমি হাসলাম আর বললাম, ‘এতটা সম্ভব নয়।’ শেষে দরদাম করে অর্ধেক দামে পেয়েও মনে হলো—বিক্রেতাই জিতে গেল!

সমুদ্রতীরে প্রথম সন্ধ্যা

সন্ধ্যার দিকে নেমে গেলাম বসফরাসের তীরে। নীল সমুদ্রের ওপর সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে নৌকা ভাসছে, পাশের রেস্টুরেন্টগুলোতে তুর্কি মিউজিক বাজছে। অর্ডার করলাম ‘বালিক একমেক’—গ্রিল করা মাছের স্যান্ডউইচ। সমুদ্রের হাওয়া আর শহরের আলো—সব মিলিয়ে ইস্তাম্বুলের প্রথম দিনটি যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল।

দ্বিতীয় দিন : বসফরাসের জলরাশি আর শহরের প্রাণশক্তি

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জানালা খুলে দেখি রোদ ঝলমল করছে। ঠিক করলাম আজ বসফরাস ক্রুজে ঘুরব।

বসফরাস ক্রুজ : দুই মহাদেশের মাঝে দাঁড়িয়ে

জাহাজ ছাড়তেই ঠান্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগল। একপাশে ইউরোপ, অন্যপাশে এশিয়া—এমন অভিজ্ঞতা পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যায়? জাহাজ এগিয়ে যেতেই দেখলাম ডলমাবাহচে প্রাসাদ, প্রাচীন দুর্গ, মসজিদ আর ঝকঝকে শহর। একসময় নৌকা সেতুর নিচ দিয়ে গেল—মুহূর্তটায় মনে হলো আমি যেন ইতিহাস, আধুনিকতা আর প্রকৃতির মাঝে কোনো সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে আছি।

ডলমাবাহচে প্যালেস : অপূর্ব জাঁকজমকের গল্প

ক্রুজ শেষে পায়ে হেঁটে গেলাম ডলমাবাহচে প্যালেসে। ভেতরে ঢুকতেই দেখি বিশাল ঝাড়বাতি—বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিস্টাল ঝাড়বাতিগুলোর একটি। এখানে প্রতিটি ঘর সাজানো রাজকীয় আসবাবে, দেয়ালে সোনালি খোদাই, ছাদের অলংকরণ যেন রূপকথার কোনো রাজমহল। গাইড আমাদের জানালেন, অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ যুগে এখান থেকেই বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পুরো জায়গাটা একাধারে সুন্দর, আবার একটু বিষাদময়ও।

ইস্তিকলাল স্ট্রিট : শহরের প্রাণ

দুপুরে চলে গেলাম ইস্তিকলাল স্ট্রিটে। রাস্তার মাঝ দিয়ে পুরোনো লাল ট্রাম ধীরে ধীরে চলছে। দুপাশে দোকান, বইয়ের স্টল, কফিশপ আর মানুষের ভিড়। কেউ গান বাজাচ্ছে, কেউ ছবি আঁকছে। এখানে দাঁড়িয়ে একটা কফি খেলাম—তুর্কি কফি; ঘন, তীব্র। ছোট এক কফিশপে বসে সংগীত শুনতে শুনতে বুঝলাম, এটাই আধুনিক ইস্তাম্বুলের আসল মুখ।

তাকসিম স্কোয়ারের রাত

রাতের দিকে তাকসিম স্কোয়ার যেন আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠেছে। পরিবার, বন্ধু, পর্যটক—সবার ভিড়ে জায়গাটা ভীষণ প্রাণবন্ত। সেখানে রাস্তার এক শিল্পীর কাছে শুনলাম ‘ইয়াল্লা’ নামের তুর্কি লোকগান। মনে হলো রাতটা আরো কিছুক্ষণ থেমে থাকুক।

তৃতীয় দিন : গালাটা টাওয়ার, গোল্ডেন হর্ন ও এশিয়ার রঙ

শেষ দিনের সকালে মনটা একটু ভারী ছিল—ভাবছিলাম আজই তো শেষ দিন।

গালাটা টাওয়ার : ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য

টাওয়ারের পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখের সামনে খুলে গেল ইস্তাম্বুলের মানচিত্র। বসফরাস নদী নীল ফিতের মতো শহরকে দুভাগ করেছে, দূরে সুলতানাহমেতের গম্বুজ ঝলমল করছে। বাতাসের ঝাপটা মুখে এসে লাগতে লাগতে মনে হলো—এ যেন আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর দৃশ্য।

গালাটা ব্রিজ : মানুষের গল্পে ভরা এক সেতু

টাওয়ার থেকে নামার পর ব্রিজের দিকে হাঁটলাম। ব্রিজের রেলিংয়ে সারি সারি মানুষ মাছ ধরছে। কেউ চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকছে, কেউ আবার চুপচাপ নিজের লাইনে মনোযোগ দিয়ে আছে। নিচের অংশে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট—সমুদ্রপৃষ্ঠের এত কাছে বসে খাওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই ভিন্ন। এখানেই খেলাম ‘মেজে’—বিভিন্ন ছোট প্লেটে পরিবেশিত তুর্কি অ্যাপেটাইজার।

কাদিকয় : এশিয়া মহাদেশে প্রথম পা

বিকালে ফেরিতে উঠে পার হয়ে এলাম এশীয় প্রান্ত কাদিকয়ে। জায়গাটা পুরোপুরি আলাদা। রাস্তার দেয়ালচিত্র, আর্ট ক্যাফে, স্থানীয় বাজার—সবকিছুতেই স্বতন্ত্র এক প্রাণবন্ত ভাব। দোকানদাররা হাসিমুখে কথা বলে, খাবারের দোকানে তাজা মাছের গন্ধ, আর কুনাফার দোকানে ঘি আর চিনি মিশে এমন ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে যে না খেয়ে থাকা অসম্ভব।

কাদিকয়ে খেয়েছিলাম জীবনের সেরা এক কুনাফা, যেটির সোনালি খাস্তা বাইরে, ভেতরে গলগলে পনির। গরম থাকতে থাকতেই খেতে হয়, নাহলে আসল স্বাদ পাওয়া যায় না। প্রতিটি কামড়েই মনে হচ্ছিল—এই শহর খাবারের মাধ্যমে মানুষকে নিজের প্রেমে ফেলে।

শেষ সন্ধ্যায় বিদায়ের সুর

ফেরিতে উঠে যখন ইউরোপীয় অংশে ফিরছিলাম, তখন সূর্য ডুবছিল। আকাশ সোনালি আর কমলা রঙে রাঙা। সিগালরা ফেরির পাশে উড়ে উড়ে ডাকছিল। হঠাৎ মনে হলো—ইস্তাম্বুল যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে।

সন্ধ্যায় বসফরাসের ধারে শেষ একটি তুর্কি চা খেলাম। চারপাশে মানুষ—কেউ হাঁটছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ গল্প করছে। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেও শহরটা যেন আমাকে আলাদা করে কিছু বলতে চাইছিল—‘আবার এসো।’

বেলাশেষে

ইস্তাম্বুল এমন এক শহর, যেখানে প্রতিটি মোড়েই গল্প লুকিয়ে আছে। তিন দিনে অনেক কিছু দেখলাম, অনেক স্বাদ নিলাম, অনেক মানুষ দেখলাম—তবু মনে হলো সবকিছুই কেবল শুরু। ইতিহাস, আধুনিকতা, ধর্ম, সমুদ্র, খাবার—সব মিলিয়ে শহরটা যেন এক জীবন্ত কবিতা।

আজও চোখ বন্ধ করলে বসফরাসের হাওয়া অনুভব করি, শুনতে পাই মসজিদের আজানের ধ্বনি আর ইস্তিকলাল স্ট্রিটের গিটার বাজানো গায়কের গান। একদিন অবশ্যই আবার যাব—হয়তো আরো বেশি দিনের জন্য, আরো গভীরভাবে শহরটাকে জানার জন্য।

লেইস ফিতা ও জাদুর বাক্স

বাইরে কিছু পুড়ছে

হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলা কথাসাহিত্যের ঘরে ফেরা (শেষ পর্ব)

বিশ্বসভ্যতার সংরক্ষণে উদ্বোধন ‘মহান মিসরীয় জাদুঘর’

বুকার প্রাইজ ২০২৫ পেলেন ডেভিড সালাই

বিমূর্ত দোলাচল

হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলা কথাসাহিত্যের ঘরে ফেরা

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, সীমান্ত ও আজকের লড়াই

পোয়েটস অ্যাভেন্যু

দুর্লভ লেখা: ইকবালের ইতিহাস-দর্শন