রাতের খাওয়া শেষ করে পারিবারিক খুনসুটিতে মগ্ন নিমাই-রাধারানী দম্পতি। পাশে এগারো বছরের ছেলে অয়ন চোখ থেকে ঘুম তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। সাংসারিক অগুরুত্বপূর্ণ আলাপের ফাঁকে ফাঁকে টিভির স্কিনে তাকাচ্ছে নিমাই। অপেক্ষা রাত ১০টার সংবাদ দেখার। হঠাৎ টিভি স্ক্রলে চোখ আটকে যায় নিমাই চক্রবর্তীর ‘পটুয়াখালী শহরের নতুনপাড়া এলাকা থেকে ইসলামি চরমপন্থি আবদুল্লাহ আল সানিকে আটক করেছে র্যাব।’
চোখ বড় করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে নিমাই। স্ত্রী রাধারানীকেও দেখায়। দুজনেই স্ক্রলের সংক্ষিপ্ত লেখাটি বারবার পড়ে। নিমাই গৌরীকে ডাক দেয়। গৌরী এসে মা-বাবার পেছনে দাঁড়ায়। উৎসুক চোখে মায়ের কাছে কী হয়েছে, জানতে চায়। রাধারানী প্রশ্ন করে, আচ্ছা, আমাদের সানির পুরো নাম কী? জানিস?
গৌরী তটস্থ হয়ে জবাব দেয়, আবদুল্লাহ আল সানি। কেন?
রাধারানী আঙুলের ইশারায় টিভির স্ক্রলে ভাসতে থাকা সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম দেখিয়ে দেয়। গৌরীর হাত-পা স্থির হয়ে যায়। সে কোনো কথা বলতে পারে না। বারবার পড়ে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নিমাই চক্রবর্তী। তারপর বলল, ছেলেটিকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না তাকে দিয়ে এ রকম একটি কাজ হতে পারে।
তার পাশে বসা স্ত্রী রাধারানী চক্রবর্তীও স্বামীর কথার সঙ্গে তাল মেলায়, আসলে মানুষ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। ছেলেটা কী করল! ভগবান আমাদের বাঁচিয়েছেন।
গৌরীও নিশ্চিত হয়ে যায়, র্যাবের আটক করা সানি আর তাদের সানি একই ব্যক্তি। তারপরও সংবাদে বিস্তারিত দেখার অপেক্ষায় থাকে।
কিছুক্ষণ পর রাত ১০টার সংবাদ শুরু হয়। গৌরীর চোখ টেলিভিশনের পর্দায়। ‘আমরা আসলে এতদিন ধরেই এই চক্রটাকে ট্রেস করার চেষ্টায় ছিলাম। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আপনারা জানেন, গত মাসে অভিযান চালাতে গিয়ে আমাদের র্যাবের তিন সদস্য তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। আর এই যে সানি, তার বয়স কম হলেও সে অতি ভয়ংকর একজন চরমপন্থি। সে আল মুজাহিদ গোষ্ঠীর সশস্ত্র শাখার সহকারী প্রধান। এই অঞ্চলে সে বিশেষ একটি অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল।’
র্যাব মিডিয়াপ্রধানের ব্রিফিংয়ের শেষ অংশ গৌরীর কানের মধ্যে ঢোকার পথ পায়নি। সে এক নাগারে স্ক্রিনের বামপাশে সানির ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে গালে নামছে।
রোজ কলেজ থেকে ফেরার সময় সানির মেসের সামনে দিয়েই ফিরতে হয়। ওই এলাকায় এলেই গৌরী আস্তে আস্তে হাঁটত, যাতে একবার সানির দেখা পায়। কিন্তু সেই ছেলেটা! যাকে দেখার প্রথম দিনই ভালো লেগেছিল। চেহারায় কেমন একটা মায়া। সানির ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির মুখটা গৌরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেন ইচ্ছে হলেই ছুঁয়ে দিতে পারে। গৌরীর মনে হয় সানি যত দূরেই থাকুক, তার এই কাতরতা সে দেখছে। ফিরে এসে গাল টেনে বলবে, ধুর! এত অল্পতে ভেঙে পড়লে চলে!
সানিকে ভালোবাসতে গিয়ে তার একবারও মনে হয়নি তারা দুজন দুধর্মের। শুধুই মনে হয়েছে ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। তাতে ধর্ম কোনো বাধা নয়। কিন্তু সরল মুখের সানি দেশ ধ্বংসের কাজে জড়িয়ে আছে, সেটি এখনো ভাবতে পারছে না গৌরী।
এখন কারো বিশ্বাস করতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। স্ক্রল দেখার পর যেটুকু বাকি ছিল, তা রাত ১০টার সংবাদ দেখে সবাই বুঝে নিল। পরিবারের সবার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা কতটা অবাক হয়েছে। আহত হয়েছে।
সানি গত সাত মাস আগে নতুনপাড়া এলাকায় আসে। মজিদ মিয়ার চারতলা বাড়ির নিচতলায় কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে মেসে ওঠে। এখানে তার পূর্বপরিচিত বন্ধু আছে। যে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার ভালো আচার-আচরণের কারণে নতুনপাড়ার প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছে ভালোবাসা পেয়ে যায়।
কয়েকদিন আগে গৌরীর সঙ্গে ছোহরাফের দেখা হয়। কলেজ থেকে ফেরার পথে ছোহরাফ দাঁড়িয়ে ছিল। গৌরীকে আসতে দেখে এগিয়ে যায়। সে জানায়, সানি ভালো ছেলে নয়। তার সঙ্গে মেলামেশা না করাই ভালো।
গৌরী ছোহরাফের কথা পাত্তা দেয় না। তিন বছর ধরে গৌরীর পেছনে পাগল হয়ে ঘুরছে ছোহরাফ। প্রথমে অনুসরণের পর্যায় ছিল। এরপর শুরু হয় সাহস দেখানোর চেষ্টা। তার পাগলামিতে গৌরী ভয় পেয়ে যায়। গৌরী বুঝতে পারে রাগ দেখিয়ে ছোহরাফকে কোনোক্রমেই তাতিয়ে দেওয়া যাবে না। বরং ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে হবে। একদিন ছোহরাফের সঙ্গে দেখা করে কলেজ ক্যান্টিনে চায়ের আমন্ত্রণ জানায় সে। ছোহরাফ খুশি মনে জ্বলজ্বলে চোখে গৌরীর সামনে যায়।
চা খাওয়া শেষ করে গৌরী বিনীত ভঙ্গিতে বলে, দ্যাখেন ছোহরাফ ভাই, শুনেছি ভালোবাসার মানুষকে খুশি রাখতে মানুষ নাকি সবাই করে। আপনি যদি আমাকে পথে কথা বলার জন্য না দাঁড় করান, তাহলে আমি খুশি হই। আপনার ভালোবাসার জন্য এটা আপনি করতে পারবেন না?
এ পর্যন্ত বলে গৌরী একটু থামে। ছোহরাফ কোনো কথা বলে না। ঢোক গিলে আবার বলা শুরু করে, তা ছাড়া আমি তো আপনার পাড়ার ছোট বোন। আমার প্রতি আপনার তো একটা দায়িত্ব আছে। নাকি?
কথা শেষ করে গৌরী ছোহরাফের মুখের দিকে তাকায়। সে এসব শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না—সেটা গৌরী ভালোভাবেই বুঝতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ছোহরাফ স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের পেছনে ঘুরে ঘুরে নিজের ক্যাডারগিরির একটা সনদ নিয়ে নিয়েছে। সে কারণে এলাকার লোকজন তাকে কিছুটা ভয় করে। গৌরীর এমন কথা শোনার পর সেই ক্যাডারের মুখখানায় রাজ্যের হতাশা।
ছোহরাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আচ্ছা। তুমি যখন আমাকে ভালোবাসো না, তখন আর তোমাকে বিরক্ত করব না। তুমি যেমন চাও তেমনটাই হবে।
ছোহরাফ এত সহজে তার কথা মেনে নেবে সেটা গৌরী বুঝতে পারেনি। তার মনের মধ্যে এক ধরনের ভয় থেকেই যায়। কারণ ছোহরাফকে সে চেনে। এটাও জানে, সে এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।
তারপর কেটে গেছে প্রায় দুই বছর। ছোহরাফের আগের চেয়ে এখন আরো বড় নেতা। নতুন কমিটিতে ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে। লোকমুখে প্রচার হচ্ছে সামনেরবার সে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচন করবেন।
গৌরী বুঝতে পারে সানির সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা যেভাবেই হোক ছোহরাফ জানতে পেরেছে। তাই হঠাৎ করে ছোহরাফের সানি সম্পর্কে মন্তব্যে চিন্তিত হয় গৌরী।
সংবাদ শেষ হতেই একটি অপরিচিত নম্বর থেকে গৌরীর মোবাইলে ফোন আসে। গৌরী ফোন রিসিভ করতেই, নিউজ দেখেছো?
গৌরী চিনতে পারে এটা ছোহরাফ। চুপ করে থাকে। ছোহরাফ বলে যায়, আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, ছেলেটা ভালো নয়। এ রকম মানুষের জন্য মন খারাপ করতে নেই। এরা দেশের শত্রু। এ রকম মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়।
তার শেষ কথাটি হুমকির মতো শোনায়। গৌরী চুপ করেই থাকে। ছোহরাফ বুঝতে পারে গৌরী তার কথার উত্তর করবে না। সে ফোন রেখে দেয়।
ছোট ভাই অয়নকে প্রাইভেট পড়ানোর সুবাদে সানিকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায় গৌরী। পছন্দের মানুষকে এত কাছাকাছি পেয়ে গৌরী নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। সুযোগ বুঝে একদিন সানির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। নিজের মনের কথা খুলে বলে। সানি কোনো উত্তর করে না। দ্বিতীয় দিন আবার নিজের আগ্রহ জানায় গৌরী। সানি নিরুত্তর। গৌরী বিরক্ত হয়, আরে আপনি দেখি মেয়েদের মতো। যে লজ্জা আমার পাওয়ার কথা, সেটা আপনি পাচ্ছেন! আপনি কেমন পুরুষ?
এবার সানির পুরুষত্বে আঘাত লাগে। সে নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করার জন্য মাথা উঁচু করে। গৌরীর দিকে তাকায়। সানি বলে, সত্যি বলতে আমি আপনাকে...
কথা শেষ করতে দেয় না গৌরী। সে খুব বিরক্ত হয়, আরে আপনি আপনি করছেন কেন?
অপরিচিত একজন মানুষকে হঠাৎ করে তুমি বলা যায় না।
আমি তো আপনার চেয়ে বয়সে ছোট।
সেদিন আর তাদের খুব বেশি কথা হয় না। সানি জানায়, বাইরে কোথাও বসে এ বিষয়ে সে কথা বলতে চায়। ঠিক হয় পরের দিন গৌরীর কলেজ ক্যান্টিনে তাদের দেখা হবে।
পরের দিন কলেজ ক্যান্টিনে দেখা হয় তাদের। গৌরীকে সানি বুঝিয়ে বলে, দেখো তোমার বাবা আমাকে অনেক পছন্দ করেন। অয়নকে পড়ানোর জন্য আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। আমি তাদের বিশ্বাসের অসম্মান করতে চাই না।
গৌরী বলে, আপনাকে অবিশ্বাসী হতে কে বলছে? আপনি তাদের ভালোবাসাকে আরো বেশি ভালোবাসা দিয়ে ফিরিয়ে দেবেন।
এ রকম কয়েক দিন কথা হওয়ার পর সানির ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। আর না ঘাটার কারণও নেই। গৌরীকে দেখলে যে-কেউ পছন্দ করবে। তাদের খুশির ঘুড়ি উড়তে থাকে। এলামোলো। ঠিকানাহীন। শেষ দেড় মাসে তারা অনেক কাছাকাছি চলে আসে। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে। সেই সানিকে হাতকড়া পড়া অবস্থায় দেখে গৌরীর খুব মায়া লাগে, কষ্ট লাগে, আবার ঘৃণা লাগে। গৌরী জানত, সানির বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙায়। সেখানে পারিবারিক ঝামেলার কারণে কী একটা মামলায় জড়িয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। রাজেন্দ্র কলেজে মাস্টার্সপড়ুয়া সানির পড়াটা তাই শেষ করতে পারিনি।
বাসার সবাই শুয়ে পড়েছে। গৌরীর চোখে কোনো ঘুম নেই। সংবাদ দেখার পরই সে সানির বন্ধু জলিলের নম্বরে ফোন দিতে থাকে। ফোন বাজছে। কেউ রিসিভ করছে না।
রাত সোয়া ৩টার দিকে জলিলের ফোন এলো। সে হাঁপাচ্ছে। গৌরীর কোনো কথা শোনার অপেক্ষা করে না জলিল। সে বুঝতে পারে সংবাদ দেখার পর গৌরীর মনের অবস্থা কতটা নাজুক অবস্থায় আছে। জলিল তাড়াহুড়ো করে জানায়, তারা সানিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। সানি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নয়। তাকে ছোহরাফ ধরিয়ে দিয়েছে।
গৌরীর কাছে সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সে বিছানায় সকালের অপেক্ষায় ছটফট করতে থাকে। কান্না করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। ঘুম ভেঙে ঘড়িতে দেখে পৌনে ৮টা বাজে। জলিলের নম্বরে ফোন দেয়। ফোন বন্ধ। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়। ভাবতে থাকে যে-করেই হোক সানিকে মুক্ত করতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে সানির কোনো দোষ নেই। সে ছোহরাফের আক্রোশের শিকার।
বাসা থেকে বের হবে তখন খেয়াল করল, সকাল ৮টার সংবাদ শুরু হয়ে গেছে। ভালো কিছু শোনার আগ্রহ নিয়ে গৌরী টিভির সামনে দাঁড়াল। প্রথমেই টপ নিউজ। ‘গতকাল র্যাবের হাতে আটক আল মুজাহিদ গোষ্ঠী’র সশস্ত্র শাখার সহকারী প্রধান আবদুল্লাহ আল সানি গতকাল রাতে র্যাবের সঙ্গে বন্ধুক যুদ্ধে নিহত।’
টিভি স্ক্রিনের একপাশে ভেসে আছে সানির হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি। অন্যপাশে মাটিতে উবু হয়ে পড়ে আছে তার রক্তাক্ত অসাড় দেহ।