আবুল কালাম শামসুদ্দীন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ধানীখোলা গ্রামে ০৩ নভেম্বর ১৮৯৭ এক সম্ভান্ত জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে এন্ট্রান্স ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে এফএ পাস করে কলকাতা রিপন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ...অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন (১৯২০-১৯২২) চলায় তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের আহ্বানে তিনি বিএ পরীক্ষা বর্জন করেন। ১৯২১ সালে তিনি ‘গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন’ থেকে ‘স্নাতক’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ ঘটে, তার অন্যতম অংশীদার তিনি। সাংবাদিকতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ উন্নয়ন, রাজনীতি ও মননশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আবুল কালাম শামসুদ্দীন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তিনি ‘নূরী’ ছদ্মনামে অসংখ্য কলাম লিখেছেন। আজাদ-এ তিনি প্রায় প্রতিদিনই সম্পাদকীয়র নিচে ‘ত্রিবিধ’ নামে কলামে তিনটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করতেন।
আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২৩ সালে কলকাতার ‘দৈনিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে। ১৯২৪ সালে ‘সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯২৫-১৯২৯ পর্যন্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘দ্য মুসলমান’-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৬ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রতিষ্ঠিত-সম্পাদিত ‘সওগাত’ এবং একই সাথে ‘দৈনিক সুলতান’-এর সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেন। ১৯২৭ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’র সম্পাদনার দায়িত্ব পান। ১৯৩৬ সালে ৩১ অক্টোবরে বাঙালি মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে তিনি এর সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজের একমাত্র বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ‘দৈনিক আজাদ’ এর সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরবর্তী ২২ বছর [১৯৪০-১৯৬২] অনন্য দায়িত্বশীলতার সাথে তিনি আজাদ সম্পাদনা করেন। ‘দৈনিক আজাদ’-এর ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক যথাক্রমে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীনের যুগপৎ ভূমিকা বিশেষ স্মরণীয়। ‘দৈনিক আজাদ শুধু মুসলিম বাংলার প্রাচীনতম সংবাদপত্রই নয়, মুসলিম বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণে এর ভূমিকা ঐতিহাসিক। পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে আমাদের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা ‘দৈনিক আজাদ’ ও ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় আলোচনার সূত্রপাত করেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগেই।’ দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে নতুন পত্রিকা ‘দৈনিক জেহাদ’-এ সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর ‘দৈনিক পাকিস্তান’ [পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা] প্রকাশিত হলে তিনি এর সম্পাদক হন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলিম সমাজকে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সচেতন করে তোলার জন্য আবুল কালাম শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে ১৯৪২ সালে কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সম্পাদক হন দৈনিক আজাদের যুগ্ম সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক মুজীবুর রহমান খাঁ। দৈনিক আজাদকে কেন্দ্র করে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্দেশ্যে এ সময় থেকেই তাঁরা তৎপর হন।
১৯৪৬ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগের মনোনয়নে ময়মনসিংহ জেলা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জোরদার হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য পদ থেকে তিনি পদত্যাগ (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) করেন। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার তিনি উদ্বোধন করেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল সাহিত্যিক। সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি প্রধানত মননশীল লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও উপন্যাস, অনুবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। বিশেষত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি ও বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে তাঁর কৃতিত্ব অসামান্য। নজরুলকে তিনিই প্রথম ‘যুগ-প্রবর্তক’ কবি বলে অভিহিত করেন। কবি ফররুখ আহমদের প্রখ্যাত ‘হাতেম তায়ী’ কাব্য সম্পর্কে তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন মহাকাব্য পর্যালোচনা ও আধুনিককালে মহাকাব্যের আকার-আকৃতি ও ধরন বিশ্লেষণ করে যুক্তিসহ প্রমাণ করেন যে, ‘হাতেম তায়ী’ একটি সফল আধুনিক মহাকাব্য।
আবুল কালাম শামসুদ্দীনের গ্রন্থাবলিÑ
অনুবাদ : ‘অনাবাদি জমি’ (প্রখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক তুর্গেনিভের ‘ভার্জিন সয়েল’-এর অনুবাদ ১৯৩৮)
‘ত্রিস্রোতা’ (তুর্গেনিভের তিনটি গল্পের অনুবাদ, ১৯৫৩]
‘খরতরঙ্গ’ (তুর্গেনিভের ‘টরেন্টস অব স্প্রিং’ গ্রন্থের ছায়ানুসরণে রচিত, ১৯৫৩)
‘ইলিয়ড’ (হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ডের বঙ্গানুবাদ, ১৯৬৭)
‘দিগ্বিজয়ী তাইমুর’ (মূল : হ্যারল্ড ল্যাম্ব)
প্রবন্ধ সঙ্কলন : ‘দৃষ্টিকোণ’ (১৯৬১)
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা : অতীত দিনের স্মৃতি (১৯৬৮)
ইতিহাস : পলাশী থেকে পাকিস্তান (১৯৬৮)
সম্পাদনা : সেকাল ও একালের সেরা গল্প (১৯৬৩)
শিশু সাহিত্য : কচিপাতা (১৯৩২)
বিবিধ : নতুন চীন নতুন দেশ (১৯৬৫)
তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় রয়েছে, যা এখনো সঙ্কলিত ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তিনি অনুবাদ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭০) এবং সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে একুশে পদক (১৯৭৬) লাভ করেন।