জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও ভোটের তারিখ নিয়ে এখনো বিভক্ত তারা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত প্যাকেজ প্রস্তাব প্রস্তুত করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যা শিগগির অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। প্রস্তাবনায় থাকবে-প্রথমে একটি বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট আয়োজন। এছাড়া পরবর্তী জাতীয় সংসদ হবে দ্বৈত ভূমিকায়-একদিকে এটি হবে নিয়মিত সংসদ, অপরদিকে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিষদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে। গণভোটের দিনক্ষণ কমিশন সরকারের ওপর ছেড়ে দেবে বলে জানা গেছে।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে একক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বেলা ৩টায় শুরু হয়ে একাধিক বিরতির পর রাত ১১টা ১৫ মিনিটে বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকে মূলত গণভোট কখন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা কোন ধরনের আদেশের ভিত্তিতে হবে—এ দুটি বিষয় ঘিরেই দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়।
বিএনপি চায় জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট নেওয়া হোক। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দাবি করছে, সংবিধান বা ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’ অনুযায়ী নির্বাচনের আগে গণভোট হওয়া উচিত।
বৈঠক শেষে সমাপনী বক্তব্যে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, দিনভর আলোচনার সারসংক্ষেপ আমরা সংগ্রহ করেছি। এখন বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সরকারকে একটি সুস্পষ্ট পরামর্শ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তিনি জানান, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন। সেগুলো হলো-জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে; ওই আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করতে হবে; গণভোটে দুটি আলাদা প্রশ্ন রাখতে হবে, যাতে ঐকমত্য ও মতবিরোধ-উভয় বিষয় স্পষ্ট হয়; নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ১৩তম জাতীয় সংসদ গঠন করতে হবে; গণভোটে অনুমোদনের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব উঠে আসে। একাধিক দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই পৃথক ব্যালটে গণভোট নেওয়ার পক্ষে আর কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশনের মতে-সবাই একমত যে, সংসদকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া উচিত।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে মতামত সমন্বয় করে সরকারকে পরামর্শ দেব। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও জোটকে অবহিত করা হবে।
তিনি আরো জানান, কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৫ অক্টোবর। এর মধ্যে তারা জুলাই সনদের ওপর একটি স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চান।
এর আগে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট দেওয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি আছে। এর আগে গণভোটের মতো মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে।
সনদের অঙ্গীকারে একটি বিষয় যুক্ত করতে হবে-যেসব দলের যে যে বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো তারা নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে সে দল তাদের ভিন্নমত অনুসারে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের গাঠনিক ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকেই আসবে এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হবে গণভোট। তার মতে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি সনদ অনুমোদন করে, তাহলে পরবর্তী সংসদের দায়িত্ব হবে সনদের ঘোষিত দফাগুলো বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যে অনুমোদন দেবে, সেটাই সংসদের ওপর বাধ্যতামূলক ম্যান্ডেট তৈরি করবে। তবে তিনি স্পষ্ট করেন, এর মানে এই নয় যে, ভবিষ্যৎ সংসদ অন্য কোনো সংস্কার করতে পারবে না, তবে জুলাই সনদের ধারাগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দিলে তা বাস্তবে জটিল হতে পারে। তিনি প্রস্তাব দেন-‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ বাক্যটি উল্লেখ করে সংসদকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে, যাতে নিয়ম পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। তিনি আরো বলেন, আপার হাউস গঠন বা সেকেন্ড হাউস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সনদ গৃহীত হওয়ার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে।
নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভিন্নমত বা আপত্তি থাকলেও তা জুলাই সনদের অংশ হিসেবেই গণভোটে যাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে এবং সে প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোট আইন বা অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকবে যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের মধ্যে আলোচনা করে গণভোটের বিধিবিধান নির্ধারণ করা হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি আইনজীবী শিশির মনির বলেন, বিশেষ সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের প্রয়োজন আছে। এ আদেশে গণভোটের কথা বলা থাকবে। তফসিলে জুলাই সনদ থাকবে। আদেশের ভিত্তিতেই গণভোট হবে। আগামী সংসদের দুটি ক্ষমতা থাকবে-একটি সাধারণ সংসদের ক্ষমতা, অন্যটি কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা। সংসদের প্রথম অধিবশেনে এ ক্ষমতা থাকবে। দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে সাধারণ সংসদ কাজ করবে। এভাবে হলে সংস্কার টেকসই হবে। তিনি বলেন, যে কয়টি বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না হলে সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়বে। তিনি বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হতে হবে। এখন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণভোট করা সম্ভব।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, সংস্কারগুলো আগামীতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বা বাতিল হবে, এমন প্রক্রিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। টেকসই করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নামে একটি আদেশ দেওয়া উচিত। জুলাই সনদ বাস্তববায়ন করা হবে কি না-এ প্রশ্নে গণভোট দেওয়া এবং আগামী সংসদকে বিশেষ কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার দেওয়া লাগবে। কারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় হাত দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সংসদকে বিশেষ ক্ষমতা দিতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে গুরুত্ব হারাবে।
দলটির আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, নোট অব ডিসেন্ট কমিয়ে আনতে পারলে বিশেষ করে উচ্চকক্ষে পিআর ভিত্তিতে হবে কি না। জামায়াতে ইসলামী যদি নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি ছেড়ে দেয় আর বিএনপি যদি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেয়, এটা একটি ভালো ট্রেড হতে পারে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন গণভোটের আয়োজনের পক্ষ মত দেয় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ ও এলডিপি। গণতন্ত্র মঞ্চ সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ভিত্তিতে গণভোট চেয়েছে। একই সঙ্গে সনদে উল্লেখ থাকবে-আগামী জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশের নাম হবে সংবিধান সংস্কার সভা এবং নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। সিপিবি-বাসদসহ সমমনা দলগুলো সংবিধান আদেশের বিপরীতে ১৯৯১ সালের গণভোট আইন অনুযায়ী ভোটের দিন গণভোট করার প্রস্তাব করে।
বিএনপির সমমনা দলগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভোটের দিন গণভোট এবং নিয়মিত সংসদের সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো সুরাহা করার প্রস্তাব দেয়।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগে বুধবার দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। সেখানে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অধ্যাদেশের অধীনে গণভোটের আয়োজন করলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ অধ্যাদেশ পরবর্তী সংসদ অধিবেশনের ৩০ দিনের মধ্যে সংসদে পাস করতে হয়। কোনো কারণে সেটি না হলে অধ্যাদেশটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রের অধীনে সংবিধান বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের অধীনে গণভোট করার পক্ষে মত দেন তারা। পরবর্তী সংসদকে নিয়মিত সংসদের সংবিধান সংস্কার পরিষদের ক্ষমতা দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। সেটিই সমাধান বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কমিশনের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানান, শুরুতে কমিশন একসঙ্গে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিলেও এখন তারা বিষয়টিকে ‘প্র্যাকটিক্যাল ইস্যু’ হিসেবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতে চাইছে।
কমিশনের এই বিশেষজ্ঞ গণভোটে কয়টি প্রশ্ন থাকবে, তা নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ভিন্নমত বা দ্বিমত থাকা বিষয়গুলো আলাদাভাবে রাখতে হতে পারে। তাই একাধিক প্রশ্নের সম্ভাবনাও আছে। তিনি আরো বলেন, কমিশনের পরামর্শগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান আলোচনার ভিত্তিতেই ‘ইভলভ’ বা পরিবর্তিত হচ্ছে।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতামত নিয়ে আজ কমিশন নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবে। সেখানে তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দিতে যাওয়া সুপারিশের লিখিত চূড়ান্ত করবে, যেটি ১২ অক্টোবরের আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করবে।