সপ্রানের প্যানেল আলোচনায় বক্তারা
অধিকার-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সকল প্রাণের নিরাপত্তা (সপ্রান)’ আয়োজিত প্যানেল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, রাজনীতিতে ঘৃণার চাষাবাদ চূড়ান্তভাবে দেশকে গণহত্যার দিকে নিয়ে যাবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন থেকেই সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান তারা।
রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত ‘নিক্যাপিং ডেমোক্রেসি: সাইলেন্সিং ডিসেন্ট বাই ক্রিপলিং বডিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন। এই আলোচনায় মূলত গত ১৫ বছরের আওয়ামী সরকার কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্ন মতাদর্শীদের পরিকল্পিত নিক্যাপিংয়ের (পায়ের হাঁটু লক্ষ্য করে গুলি) মাধ্যমে পঙ্গু করে ভিন্নমত দমন করত, নির্দিষ্টভাবে সেদিকে আলোকপাত করা হয়েছে।
এ সময় বক্তারা বলেন, ‘ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য আওয়ামী লীগের আমলে নিক্যাপিংয়ের পদ্ধতিগত চর্চা করা হয়েছে। এই চর্চার একটা বড় পরীক্ষাগার (ল্যাবরেটরি) ছিল সাতক্ষীরা। সারা পৃথিবীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত রকমের উপাদান আছে মাঝের বেশ কয়েক বছর তার বেশ কিছু বোধ হয় সাতক্ষীরায় প্রয়োগ করা হয়েছে। বিশ্বের যেখানেই এগুলো হয়েছে সেখানে এটা ছিল ‘ননস্টেট অ্যাক্ট’। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মধ্যে ইসরাইলকে নিক্যাপিং করতে দেখা গেছে, তা-ও আবার নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু নিক্যাপিং যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নিজের দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটার প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে সাতক্ষীরায়। একটা আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির বাড়ি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বুলডোজিং করে দিতে পারে, এটা প্রথম সাতক্ষীরায়।’
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ইতিহাসের দায় মেটাতে হলে নিক্যাপিংয়ের প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধান করে, দায়ীদের চিহ্নিত করা এবং বিচারের ব্যবস্থা করা উচিত। যেই পুলিশ অফিসাররা এগুলো করতো তাদের যে ওপর থেকে আলাদা নির্দেশনা দেওয়া হতো তা নয়; বরং যারা এসব কাজ করেছে তারা মহান পবিত্র দায়িত্ব মনে করে এসব কাজ করেছে। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশক পরেও আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ঘৃণার চাষাবাদ। আমাদের এই ঘৃণার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ কাজ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের একটা যোগ্য নেতৃত্ব দরকার। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, নিক্যাপিং বা এর চেয়ে জঘন্য কিছু ঘটবে না- সেটার কোনো নিশ্চয়তা নাই।’
ড. মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে গত দুই-তিন দশক ধরে যেভাবে ঘৃণার চাষাবাদ হয়েছে, একটা জাতির ক্ষেত্রে এই জাতীয় ঘৃণার চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে গণহত্যা (জেনোসাইড)। আমাদের বোধ হয় সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। নিক্যাপিং বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেই অপরাধগুলো দেখেছি এটা আমাদের পূর্বসতর্কতা। আমরা চাই এখানে ঘৃণার চাষ যেন না হয়।’
নিক্যাপিংয়ের ভুক্তভোগী মো. লিমন হোসেন তার উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন, চিকিৎসকদের অবহেলা, রাষ্ট্র কর্তৃক মামলা ও হয়রানির বিষয়গুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল পায়ে গুলি না করে মাথায় গুলি করলে, হয়ত বেঁচে যেতাম।’
নিক্যাপিংয়ের ভুক্তভোগী শামছুল আলম বুলবুল বলেন, ‘যখন গুলি করেছে মনে হয়েছে আমার পা দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, সামনে নতুন যে সরকারেই আসুক না কেন, তারা যেন আর স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে, দলীয় স্বার্থে যেন মানুষকে আর হত্যা করা না হয়- সে জন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বিশেষ করে গণমাধ্যম, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীসহ দেশের সব নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আগামীতে দায়বদ্ধতার সঙ্গে সামাজিক সংস্কার বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক সোহেল রানা, মানবাধিকারকর্মী মোশফিকুর রহমান জোহান, সপ্রানের গবেষক নুসরাত জাহান নিসু, রিসার্চ ডিরেক্টর মো. জারিফ রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সপ্রানের গবেষক জেবা সাজিদা সারাফ।