হোম > জাতীয়

খায়রুল হকের বিচারিক প্রতারণা রায় ছিল কলঙ্কিত

সাইদুর রহমান রুমী

সাবেক প্রধান বিচারপতি খাইরুল হক।

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের রায়কে কলঙ্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ চিহ্নিত করে তা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে বৃহস্পতিবার যুগান্তকারী এ রায় ঘোষণা করেন। ২০১১ সালে দেওয়া তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রায়কে বিচারিক প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা।

আইনজীবীরা জানান, ওই রায় ঘোষণার আগে বিচারপতি খায়রুল হককে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ত্রাণ তহবিল থেকে মোটা অংকের টাকাও দিয়েছিলেন। এটি একজন বিচারপতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক ঘটনা। মূলত হাসিনার ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির রায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

আইনজীবীদের মতে, খায়রুল হকের রায়গুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিতর্কিত রায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত রায়। তার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেয়। এ মামলায় তৎকালীন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিঞা, নাজমুন আরা সুলতানা ও ইমান আলী রায় দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে। সর্বোচ্চ আদালত এ মামলায় সে সময় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন।

তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এমনকি সে সময়ের আওয়ামী লীগের নিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে খায়রুল হক হাসিনার সুযোগসুবিধা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে তার কাস্টিং ভোট দেন। ফলে রায়টি আপিল বিভাগের বিচারপতিদের চার-তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়। আপিল বিভাগে সাত বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে প্রকাশ্যে দেওয়া রায়ের মূল অংশ ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হবে।

কিন্তু খায়রুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত আদেশ পরে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাল্টে দেন। তার অবসর নেওয়ার ১৬ মাস পরে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয় । আইনজ্ঞদের মতে, একজন বিচারপতি হিসেবে এটি শুধু খায়রুল হকের বিচারিক অসদাচরণই ছিল না, ছিল প্রতারণা ও এক প্রকার জালিয়াতি। খায়রুল হকের এ কর্মের কারণেই হাসিনা টানা তিনটি একতরফা নির্বাচন শেষ করার সুযোগ পেয়েছেন আদালতের দোহাই দিয়ে, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ধ্বংস করে দেয়।

বিস্ময়কর হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে খায়রুল হক উল্লেখ করেছিলেন, বিচারপতিরা অবসর নেওয়ার পর লাভজনক কোনো রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের দেওয়া রায় নিজেই বারবার লংঘন করেন। এর আগে হাইকোর্ট বিভাগে থাকাকালে তিনি মুজিব হত্যা মামলার রায় ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার বিতর্কিত রায় দিয়েছিলেন। তিনি ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করেও রায় দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট রুলস ও সিপিসি (সিভিল প্রসিডিউর কোড) অনুযায়ী ওপেন কোর্টে (প্রকাশ্য আদালতে) ঘোষিত রায় এভাবে সংশোধন ও পরিবর্তন করা যায় না। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায় পরিবর্তন, পরিমার্জন অথবা সংশোধন করতে হলে রিভিউ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।

সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে সেই ক্ষমতা আপিল বিভাগকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই সংক্ষিপ্ত রায় পরিবর্তন করেছেন। সংক্ষিপ্ত রায় পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরিবর্তন করার বিষয়টি বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া তার রায়ে সে সময় সামান্য বলার চেষ্টা করেছিলেন ।

ব্যারিস্টার কাজল আরো বলেন, সিপিসি অর্ডার-২০ অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষিত হলে সেটা ওপেন কোর্টে স্বাক্ষর করতে হবে এবং সেটা পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু আমাদের সুপ্রিম কোর্টে প্রকাশ্য আদালতে স্বাক্ষর করার বাধ্যবাধকতা নেই। এ ছাড়া আগের কোনো বিচারপতি রায় লিখে গেলে তার উত্তরাধিকারী বিচারপতি ওই রায় ঘোষণা করতে পারেন। বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার পর রায়ে স্বাক্ষর করার কোনো এখতিয়ার ছিল না। তার মানে খায়রুল হক একজন বিচারক হয়ে জালিয়াতি করেছেন।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর দেশে যে নির্বাচন হয়নি, দিনের ভোট রাতে হয়েছে, মারামারি-কাটাকাটি হয়েছে, স্বৈরতন্ত্রের উত্থান হয়েছে, সবকিছুর জন্য দায়ী সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। আপিল বিভাগ দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু খায়রুল হক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ আদালতকে ব্যবহার করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর তৈরি হয়েছিল। গণতন্ত্র ধ্বংস করে তিনি শত শত মানুষ হত্যার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল রায়টি লেখার ক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ যারা তার সহায়ক ছিলেন, তারা দণ্ডবিধির ২১৯ ধারায় অপরাধ করেছেন। আমাদের আইনে রায়ের সংজ্ঞা বলা আছে, যেটা মুখ দিয়ে ঘোষণা করা হয়, সেটাই রায়। এটা পরিবর্তনের পদ্ধতিও রয়েছে আইনে। তবে তারা কোনো কিছুই অনুসরণ না করে ঘোষিত রায়কে নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে দিয়েছেন। এটা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, দেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর মেইন আর্কিটেক্ট হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।

খায়রুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, বিচারক হিসেবে লোভের বশবর্তী হয়ে দুর্নীতিমূলক, বিদ্বেষাত্মক এবং বেআইনিভাবে রায় দেওয়াসহ বিচারপতি খায়রুল হকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র আইনজীবীরা জানান, দিল্লির নীলনকশায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে আওয়ামীকরণ করার পুরস্কার হিসেবে খায়রুল হককে দীর্ঘদিন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ দেয় শেখ হাসিনা । এমনকি তাকে প্লট, ফ্ল্যাট উপহারও দেওয়া হয়। নিজের চিকিৎসার নামে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি। দেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার পথ ধরেই পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি পদে বসা এস কে সিনহা দিল্লির ইচ্ছামতো বিচার বিভাগ পরিচালনা করেন।

এছাড়া ২০০৯ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে জিয়াউর রহমান নন, শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দেয় বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। রায়ে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র’র তৃতীয় খণ্ড বাতিল ঘোষণা করেন।

এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেন খায়রুল হক। রায়ে বলা হয়েছিল, যারা এ রকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত, তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে সন্নিবেশ করার জন্যও সরকারকে নির্দেশ দেন এই বিচারপতি।

সশস্ত্র বাহিনী দিবস আজ

সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বাহিনীর সদস্যদের প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা

বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় অনুমোদিত

৫৯৩ চিকিৎসকের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি

প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলেন ছাত্রলীগ নেত্রী

পোস্টাল ভোটিংয়ের প্রথম দিনেই সাড়ে ৩ হাজার নিবন্ধন

৫০ কোটির প্রকল্প অনুমোদনসহ আরো যেসব ক্ষমতা পাবেন প্রধান বিচারপতি

নির্বাচিত সরকারকে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে বাধ্য করতে হবে

বাড়িতে আগুন দেয়া নিয়ে যা বললেন ডাকসু নেত্রী রাফিয়া

একদিনে ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু