রাজধানীজুড়ে ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন
প্রস্তুত মানিক মিয়া এভিনিউ
বিষণ্ণ ও শোকার্ত হৃদয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার শেষ বিদায়ের প্রহর গুনছে রাজধানী ঢাকা। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এই নেত্রীর নামাজে জানাজা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন অনুষ্ঠান ঘিরে পুরো ঢাকা শহরকে আজ এক অভেদ্য নিরাপত্তা দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। বিশেষ করে জানাজাস্থল জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া এভিনিউসংলগ্ন বিশাল এলাকায় এখন কেবলই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পাহারা আর হাজারো মানুষের দীর্ঘশ্বাসের অপেক্ষা।
আজ দুপুর ২টায় অনুষ্ঠিতব্য এই জানাজাকে কেন্দ্র করে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। জনসমাগমের বিশালতা এবং আবেগঘন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাত থেকেই রাজধানীর রাজপথে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের হাজার হাজার সদস্য।
১০ সহস্রাধিক সদস্যের সমন্বিত নিরাপত্তা বলয়:
সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় রাজধানীর রাজপথে ১০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর চৌকস সদস্যরা, ডিবি পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে প্রস্তুত রয়েছে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায়।
মূল শহরের ট্রাফিক ও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ।
পাশাপাশি সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিবিকে মোতায়েন করা হয়েছে সংসদ ভবন এলাকা, এভারকেয়ার হাসপাতাল ও জিয়া উদ্যানসহ রাজধানীর স্পর্শকাতর ‘কি-পয়েন্ট’গুলোতে। দেশের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও নির্দিষ্ট অবস্থানে থেকে নিরাপত্তা তদারকিতে সহায়তা করছেন। সব মিলিয়ে পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএন এবং সেনাবাহিনীর এক নিশ্ছিদ্র ও সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে ঢাকার রাজপথে।
রাত থেকেই সতর্ক পাহারা ও চেকপোস্ট:
রাজধানীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মানিক মিয়া এভিনিউ এবং সংসদ ভবনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতিটি যানবাহনে তল্লাশি চালানো হচ্ছে রাত থেকেই। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, আজ সকাল ৭টা থেকেই নির্দিষ্ট রুটগুলোতে সাধারণ যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ অথবা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানটি এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে যখন যাত্রা শুরু করবে, তখন সেই রুটটিকে গ্রিন করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
প্রযুক্তি ও ড্রোন ব্যবহারে কড়াকড়ি:
নিরাপত্তার অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। জানাজাস্থল ও তার আশপাশে কোনো প্রকার ব্যক্তিগত ড্রোন বা রিমোট কন্ট্রোল ক্যামেরা ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আকাশপথের নিরাপত্তায় উচ্চপ্রযুক্তির জ্যামার ব্যবহার করা হতে পারে। এছাড়া জানাজায় অংশ নিতে আসা জনসাধারণের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে তারা কোনো প্রকার ব্যাগ, ভারী সরঞ্জাম কিংবা সন্দেহভাজন কোনো বস্তু সঙ্গে না আনেন। প্রতিটি প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর এবং আর্চওয়ের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের তল্লাশি করা হবে।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ:
নিরাপত্তা তদারকিতে মাঠে থাকা একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এটি কেবল একটি জানাজা নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক বিশাল জনসমাগমের ক্ষেত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনৈতিক আবহে যে আবেগের বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস থাকতে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই এই কঠোর অবস্থান।
ডিএমপির মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন,
“আমরা চাই অনুষ্ঠানের প্রতিটি স্তর যেন মর্যাদা ও শান্তির সঙ্গে সম্পন্ন হয়। জনসাধারণ যেন স্বাচ্ছন্দ্যে উনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, সেজন্য প্রতিটি কিলোমিটারে আমাদের নজরদারি টিম কাজ করছে।”
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, মানিক মিয়া এভিনিউতে ভিড় সামলানোই তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আগে থেকেই জনসমাগমের ধারণা নিয়ে তারা পর্যাপ্ত পার্কিং জোন এবং ডাইভারশন পয়েন্ট তৈরি করে রেখেছেন।
জনসাধারণের প্রত্যাশা ও আবেগ:
এদিকে জানাজায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভোরেই ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাকর্মীরা একে অপরের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করছেন। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে সাধারণ মানুষের জটলা আর প্রিয় নেত্রীকে হারানোর শোক এখন দৃশ্যমান। বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা মানুষকে শৃঙ্খলার সঙ্গে চলাচল করার জন্য মাইকিং করছেন।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল এলাকা থেকে শুরু করে গুলশান ও বনানী হয়ে সংসদ ভবন পর্যন্ত বিস্তৃত এই যাত্রাপথে রাস্তার দুই পাশে সাধারণ মানুষের সম্ভাব্য উপচে পড়া ভিড় সামলাতে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি রয়েছে। সর্বত্রই এক গম্ভীর এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি:
দুপুর ২টায় জানাজা শেষ হওয়ার পর সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার মধ্য দিয়ে দাফনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। জানাজার শুরু থেকে দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়জুড়েই নিরাপত্তা বাহিনীর রেড অ্যালার্ট বজায় থাকবে। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, এই শোকের পরিবেশে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা বা শান্তিভঙ্গ সহ্য করা হবে না।
সব মিলিয়ে এক শোকাতুর বিদায়ের মাহেন্দ্রক্ষণে পুরো ঢাকা এখন নীরব শহর। প্রিয় নেত্রীকে শেষবারের মতো দেখতে আসা মানুষের ঢল আর নিরাপত্তার এই বিশাল কর্মযজ্ঞ—সব মিলিয়ে আজকের দিনটি দেশের ইতিহাসে এক অনন্য ও স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুরো প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে বলেই প্রত্যাশা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।