ভারতের প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাস উসকে দিচ্ছেন গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা। দিল্লিতে বসে তার প্রাণনাশের হুমকি, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা-এসব বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করা হয়। পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করা হয়। এছাড়া জুলাই বিপ্লবীদের ‘জঙ্গি’ আখ্যা দেওয়া, ঢাকায় ভারতীয় ভিসা সেন্টার বন্ধ ঘোষণা, জুলাই ঐক্যের ডাকে হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, দিল্লির কোনো নসিয়ত শুনতে রাজি নয় ঢাকা। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে নসিহত করছে। আমরা তাদের কোনো নসিহত শুনতে রাজি নই। আমরা কী করব, তা আমরাই ভালোভাবে জানি। গত ১৫ বছর তাদের তো এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে দেখিনি।
তিনি আরো বলেন, ভারতের সঙ্গে আমরা একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক চেয়েছি, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।
দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে গতকাল তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সর্বশেষ ভারতের যে বক্তব্য এসেছে, তাতে আমাদের নসিহত করা হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না।
তৌহিদ হোসেন বলেন, এই সরকার ডে ওয়ান থেকে স্পষ্টভাবে বলে আসছে যে আমরা অত্যন্ত উঁচু মানের, মানুষ যেন ভোট দিতে যায়, এমন পরিবেশ তৈরি করতে চাই, যে পরিবেশ গত ১৫ বছর ছিল না। ভারত আমাদের নির্বাচন নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে। এটাকে আমি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে করি। তারা জানে এর আগে গত ১৫ বছর যে সরকার ছিল, তাদের সঙ্গে ভারতের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক ছিল, সে সময় তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে তো আমাদের নসিহত করার প্রয়োজন নেই।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা কী করব? আমরা এমন একটা নির্বাচন করব, যেখানে মানুষ ভোট দিতে পারবে। যাদের ভোট দেবে, তারাই নির্বাচিত হবে, যেটা এর আগে গত ১৫ বছরে ঘটেনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছে। তাহলে তো তারাও ভারতের মতো নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছে বলা হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টা কিন্তু এক রকম না।
তাদের সঙ্গে আমাদের কিছু যোগাযোগ সব সময় আছে এবং তাদের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। কারণ, আমরা চাই যে তারা এখানে তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাক।
এ পর্যায়ে ভারতের বক্তব্য নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারতের এই নসিহত আমরা গ্রহণ করতে পারি না। বিশেষত এ কারণে যে তাদের তো এই সেন্টিমেন্টটা দেখা যায়নি গত ১৫ বছর। হঠাৎ করে এটা কেন তারা চেয়ে বসল?
গত রোববার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। সেদিন ভারতীয় দূতকে তলবের প্রতিক্রিয়ায় দিল্লির ইস্যু করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ভারতের অবস্থান। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।
দু-দেশের দূতদের তলব-পাল্টা তলব নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা তাদের হাইকমিশনারকে ডেকেছি। আমরা যা কিছু বলেছি, তা তারা গ্রহণ করেনি। সে বিষয়ে তাদের কিছু দ্বিমত আছে। একইভাবে আমাদের হাইকমিশনারকেও ডেকেছে। এটা খুব অপ্রত্যাশিত না। সাধারণত এটা ঘটে।
তিনি বলেন, আমরা জানি আগে শেখ হাসিনা ভারতে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য দিতেন। এখন প্রতিনিয়ত মূল ধারার গণমাধ্যমেও তার বক্তব্য আসছে এবং সেই বক্তব্যে প্রচুর উসকানি আছে। যিনি একটা আদালত থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি আমাদের পাশের দেশে বসে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। সেই ক্ষেত্রে আমরা তার বক্তব্য বন্ধ বা তাকে ফেরত চাইব, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে দিল্লি। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাওয়ের যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি। তবে এমন কর্মসূচিতে তাদের উদ্বেগ স্বাভাবিক।
ভারত খুনি-সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল করতে চাইলে সে দেশের ‘সেভেন সিস্টার্স’ও ভেঙে দেওয়া হবে বলে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ বক্তব্য দিয়েছেন। এটা সরকারের বক্তব্য কি নাÑজানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটা সরকারের বক্তব্য নয়। সরকারের বক্তব্য হলে তো আমি বলতাম বা অন্য কোনো উপদেষ্টা বলতেন।
এবারের বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য নেতারা তাদের বার্তায় বাংলাদেশের নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ভারত সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখতে চায়।
বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব
নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশে ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লির গভীর উদ্বেগ জানাতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। তাকে তলব করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বি শ্যাম।
এদিকে, গতকালই নিরাপত্তা পরিস্থিতির কথা বলে দুপুর ২টা থেকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানো হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসার আবেদন কেন্দ্র তাদের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশে ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে নয়াদিল্লির গভীর উদ্বেগ জানাতে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজকে তলব করে। এ সময় বিশেষভাবে তার মনোযোগ আকর্ষণ করা হয় কিছু চরমপন্থি গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের দিকে, যারা ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন ঘিরে নিরাপত্তা বিঘ্নের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘চরমপন্থি মহল’ যে ভুয়া বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে, ভারত তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এর ভিত্তি গড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সংগ্রামে, যা পরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে আরো সুদৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে ভারত রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে আসছে ভারত।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন ভারতীয় মিশন ও পোস্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেÑএমনটাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নয়াদিল্লির প্রত্যাশা।
জুলাই বিপ্লবে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যান। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে বাংলাদেশ একাধিকবার ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। তবে দেশটি এখনো সাড়া দেয়নি।
ভারতে অবস্থান করে হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্রুত অবসান চায় ঢাকা। গত রোববার সকালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে এ বার্তা দেয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেদিন সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রণয় ভার্মাকে তলব করেন। এ সময় ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত উসকানিমূলক বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের গভীর উদ্বেগের বিষয়টি প্রণয় ভার্মাকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
শরীফ ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টার ঘটনার দুদিন পর ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। হাদি হত্যাচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা ভারতে প্রবেশ করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর আহ্বানও জানায় বাংলাদেশ।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীরা ভারতে বসে বাংলাদেশের আসন্ন সংসদ নির্বাচন বানচালে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর ষড়যন্ত্র করছে বলেও প্রণয় ভার্মাকে বার্তা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত রোববার তলবের সময় ভারতের হাইকমিশনারকে এসব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুরক্ষায় বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়াবে ভারত সরকার।