জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী আওয়ামী দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করতে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপ প্রশংসা কুড়ালেও জনশক্তি রপ্তানির খাতটি চলছে চরম অবহেলায়। এই সুযোগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) একটি অসাধু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে খোদ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। প্রভাবশালী কয়েকজনের ছত্রছায়ায় বিএমইটিকে অনিয়মের আখড়া বানিয়েছে এই সিন্ডিকেট। এ সুযোগে বছরের পর বছর সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে বর্তমানে প্রবাসী রয়েছেন এক কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার ৯৮৮ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে সৌদি আরবে রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ। তাদের মধ্যে ২০২৪ সালে সৌদিতে গেছেন ছয় লাখ ২৮ হাজার। আর ২৫ সালে গেছেন সাত লাখের বেশি শ্রমিক। তাদের মধ্যে এ বছরে যারা গেছেন তাদের সৌদিতে পৌঁছতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা (প্রতিজন সবনিম্ন তিন লাখ টাকা করে)।
সৌদির পর শ্রম রপ্তানির বাজার ধরতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, লেবানন ও মালয়েশিয়া। বিশ্বের সব দেশে শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে এদের প্রত্যেককেই নিতে হয়েছে বিএমইটি থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র। এজন্য হাজার হাজার কোটি টাকার শ্রম রপ্তানির বাজার নিয়ন্ত্রণে বিএমইটি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে টানতে চলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মধ্যে সীমাহীন অবৈধ আর্থিক লেনদেন।
অভিযোগ আছে, বিএমইটিতে মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে সালেহ আহমদ মোজাফফর থাকলেও তার আশকারায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন কর্মসংস্থান বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আব্দুল হাই। এই এডিজির দাপটে তৈরি হয়েছে শক্ত সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটে প্রকাশ্যে রয়েছেনÑইরাকস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আমির আব্দুল্লাহ মো. মঞ্জুরুল করিম, থাইল্যান্ড দূতাবাসের সাবেক কাউন্সেলর (শ্রম) ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া এবং টিএম ওভারসিজের মালিক এএইচএম মইনুদ্দিন তিতাস। মূলত তাদের কাছে জিম্মি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
আমার দেশ-এর হাতে আসা নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত বিএমইটির পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আব্দুল হাই। পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সংযুক্ত থাকলেও বিএমইটি থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে হয়নি তাকে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে বিএমইটির অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়।
অভিযোগ আছেÑশেখ মুজিবকে নিয়ে কবিতা লিখে তিনি আগেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিলেন। এজন্য তিনি বিএমইটি পাড়ায় ‘কবি আব্দুল হাই’ নামেও পরিচিত। এছাড়াও ফেব্রুয়ারিতে ডিজির চাকরি শেষ হলে ভারপ্রাপ্ত ডিজি হওয়ার জন্য আব্দুল হাই তদবির করছেন বলেও জানা গেছে।
তথ্যানুযায়ী, পয়লা ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে আব্দুল হাইয়ের বদলির আদেশ হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয় ৭ তারিখের মধ্যে বর্তমান কর্মস্থল থেকে বদলির স্থানে যোগদান না করলে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত বলে গণ্য হবেন।
আরেক আদেশে বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করার জন্য বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শফিউর রহমানকে। তিনি ইতোমধ্যে যোগদান করলেও চেয়ার ছাড়েননি আব্দুল হাই। ৭ তারিখ শেষ হলেও তাকে করা হয়নি অবমুক্ত।
চাকরির ক্ষতি হবে এ ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমইটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এডিজি আব্দুল হাই চেয়ারে থাকার জন্য মোটা অংকের টাকা খরচ করেছেন। তার টার্গেট পূরণ হওয়ার আগে পর্যন্ত বিএমইটির এডিজির চেয়ার ছাড়বেন না তিনি। তার পেছনে মন্ত্রণালয়ের এক নীতি-নির্ধারকের ছায়া আছে।
তাছাড়া এক উপদেষ্টার সাবেক পিএস আব্দুল হাইয়ের বিষয়ে দেখভাল করে থাকেন বলেও জানান তারা। ফলে ইরাক ও কম্বোডিয়া শ্রমবাজারে এই সিন্ডিকেট সক্রিয়। তাছাড়া পাসপোর্ট জালিয়াতি করে সৌদিতে নারী পাচারের ক্ষেত্রেও তিনি মন্ত্রণালয় এবং দুদকের তদন্তকে পাত্তা দিচ্ছেন না।
আব্দুল হাইয়ের টার্গেট সম্পর্কে তারা বলেন, বিএমইটির বহির্গমন শাখায় বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার সৌদি আরবগামী কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র পেন্ডিং রয়েছে। যাদের চেম্বার অব কমার্স সার্টিফিকেটে সমস্যা রয়েছে। এসব কাজ অবৈধভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শেষ করার চেষ্টা করছেন তিনি। যেখানে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, যা-ই হোক আগামী বছরের জানুয়ারির ১৫ তারিখের আগে আব্দুল হাইয়ের বদলি হবে না। এজন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে লবিং হয়েছে।
এদিকে, কম্বোডিয়ার শ্রমবাজার তাদের পছন্দের রিক্রুট এজেন্সি টিএম ওভারসিজকে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে চক্রটি। বিশেষ সুবিধা দিতে ৫ অক্টোবরের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখা-৪ থেকে ব্যাংককস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত বরাবর একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। যেখানে বলা হয়, টিএম ওভারসিজ ৮৯১ জন বাংলাদেশি কর্মী কম্বোডিয়াতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে সেলফ-এমপ্লয়মেন্ট ওয়ার্ক পারমিটের মাধ্যমে কাজে যোগদানের জন্য গমন করবেন। তাদের কম্বোডিয়া গমনের পর কম্বোডিয়ার লেবার মিনিস্ট্রি থেকে সেলফ-এমপ্লয়মেন্ট ওয়ার্ক পারমিট কার্ড ইস্যু করার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করবে মর্মে রিক্রুটিং এজেন্টের প্যাডে অঙ্গীকার করেছে। এ অবস্থায়, রিক্রুটিং এজেন্সির দাখিল করা পত্রের আলোকে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। অথচ অন্য কোনো এজেন্সির ক্ষেত্রে এমন চিঠি ইস্যু করা হয়নি।
এছাড়া, সাত বছর পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ইরাকের শ্রমবাজার সচল হলে আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে এই সিন্ডিকেট। ফলে অন্য এজেন্সিগুলো চাহিদা নিয়ে এলেও দূতাবাস সত্যায়ন করতে নানা টালবাহানা করছে।
আমার দেশের কাছে আসা কিছু চাহিদাপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টিএম ওভারসিজের এক হাজার চাহিদাপত্র সত্যায়ন করলেও অন্য এজেন্সিগুলোকে তা দেওয়া হয়নি। এ পর্যন্ত টিএম ওভারসিজের প্রায় আড়াই হাজার চাহিদা সত্যায়ন করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া অন্যান্য এজেন্সিগুলো শ্রমিক পাঠানোর চাহিদা আনার পরও সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কাউন্সেলরের (শ্রম) অফিসিয়াল ইমেইল অ্যাড্রেসে নিয়োগকর্তা কোম্পানি মেইল করলেও সত্যায়নের জন্য কোনো সাড়া পায়নি।
ইরাক শ্রমবাজার নিয়ে আল সামারা ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজিং পার্টনার মো. আবু তাহের আমার দেশকে বলেন, আমার ছোট এজেন্সি। এই সেক্টরে যার দাপট আছে সেই রাজত্ব করছে। আমাদের তো আত্মীয়-স্বজন প্রশাসনে নেই। তাই আলাদা সুযোগ পাওয়া তো দূরের কথা, সঠিক কাজ থাকলেও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হতে হয়।
জানা যায়, ইরাকস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আমির আব্দুল্লাহ মো. মঞ্জুরুল করিম হলেন বিসিএস (প্রশাসন) ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা। অর্থাৎ এডিজি আব্দুল হাইয়ের ব্যাচম্যাট ও বন্ধু। আর টিএম ওভারসিজের মালিক মঈনুদ্দিন তিতাস হলেনÑস্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের স্বামী। ফলে এই সেক্টরে বাধাহীন আধিপত্য চলছে তাদের।
বিএমইটি সিন্ডিকেট চক্রের শিকড় এতই শক্ত যে নারী পাচার নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশকেও তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের ২৮ আগস্ট ‘মানব পাচারে লিপ্ত ৯ কর্মকর্তা ও ২৩ এজেন্সি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমার দেশ। যেখানে ৯ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয় তুলে ধরা হয়।
অন্যদিকে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাচার নিয়ে আরো প্রায় ২৫০টি পাসপোর্টের যাবতীয় কাগজপত্র আমার দেশ-এর হাতে এসেছে। যেখানে এডিজি আব্দুল হাই জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিএমইটি ও মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়, তদন্ত হলে আব্দুল হাই ফেঁসে যাবেন। এজন্য তিন মাস পার হলেও তদন্ত আটকে আছে। এছাড়া, সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখে ‘ব্যাংকক দূতাবাসের ইমেইল হ্যাকড, দানা বাঁধছে রহস্য’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমার দেশ। এতে বলা হয়, ১৪ সেপ্টেম্বর থাইল্যান্ডস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের ইমেইল আইডি হ্যাক হয়েছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) ফাহাদ পারভেজ বসুনিয়া ঘটনার তিনদিন পর অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর দূতাবাস থেকে বিষয়টি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে (বিএমইটি) চিঠির মাধ্যমে জানান।
এই চিঠিতে ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যদি কোনো কাগজপত্র সত্যায়ন করা হয়ে থাকে তবে তা বাতিলের অনুরোধ করা হয়। বর্ণিত তারিখের সত্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে যতগুলো ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে এগুলো আদৌ চিহ্নিত করা হয়েছে কি না তাও শনাক্ত করেনি বিএমইটি।
কম্বোডিয়া নিয়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠি প্রসঙ্গে টিএম ওভারসিজের মালিক এএইচএম মইনুদ্দিন তিতাস বলেছেন, মন্ত্রণালয় যে কারো জন্য এমন চিঠি দিতে পারে। এটা আলাদা সুযোগের বিষয় নয়।
ইরাক শ্রমবাজারের সত্যায়ন প্রসঙ্গে ইরাকস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আমির আব্দুল্লাহ মো. মঞ্জুরুল করিম বলেছেন, যে কোম্পানি থেকে চাহিদা আনা হয়েছে এগুলোর ঠিকানা নেই। তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি এবং কোম্পানির লোকেশন দেয়নি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাইয়ের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলেও সাড়া মেলেনি। বক্তব্য জানতে তার অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
বিষয়টি নিয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর আমার দেশকে বলেন, নারী পাচার প্রসঙ্গে অতিরিক্ত মহাপরিচালক আশরাফ হোসেনকে তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্যÑকিন্তু তিন মাসেও হচ্ছে না। এর কারণ কীÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দুদকও চিঠি দিয়েছে। এজন্য আমরা একটু সময় নিচ্ছি।