নিত্যপণ্যের বাজারে নির্বিকার সরকার
বাজারে সিন্ডিকেট চক্রের খেলায় নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক উঠানামা করছে। এতে গত কয়েকদিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজি করে ভোক্তাদের পকেট কেটে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্রটি। বাজারে সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় তা সরকার স্বীকার করে বক্তব্য ও বিবৃতি দিলেও বাস্তবে সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পেঁয়াজের দাম কারসাজি করে বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। এরপরও বেড়ে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা হলে সবার জন্য ভালো। বাজার নিয়ন্ত্রণে যোগসাজশ থাকলে কৃষি কর্মকর্তাদের চাকরি থাকবে না। ব্যবসায়ীদের কারসাজি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখবে।
এর আগের সপ্তাহে কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আমদানি কারকদের চাপ থাকলেও কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় এবার আর পেঁয়াজ আমদানি না করার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানির জন্য আমাদের ওপর অনেক চাপ দিয়েছে। তারা এ বিষয় নিয়ে আদালতেও গেছেন। কিন্তু পেঁয়াজ আমদানি না করার সিদ্ধান্ত বদল হবে না সরকারের।
অন্যদিকে গত বুধবার (৩ ডিসেম্বর) দুপুরে সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্মতি নেয়নি। মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়েছে তারা। এর বিরুদ্ধে সরকার আইনসম্মত ব্যবস্থা নেবে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ব্যবসায়ীদের থেকে সরকার বাজারের দামের চেয়ে ২০ টাকা কমে ভোজ্য তেল কিনেছে। তবে তারা বাজারে ২০ টাকা বাড়িয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। দাম বাড়ানোর যৌক্তিক কারণ থাকলে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অযৌক্তিক কোনো বিষয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মানবে না। ব্যবসায়ীরা শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ করলে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর ৪ দিন পরেই দেখা গেল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দাম সমন্বয় করা হয়। ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দাম সমন্বয় করা হয়েছে। নতুন দাম সোমবার (৮ ডিসেম্বর) থেকে কার্যকর হবে।
এতে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৬ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেন ব্যবসায়ীরা। তবে কয়েকদিন আগে প্রতি লিটার তেলের দাম ৯ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা, যা অনুমোদন দেয়নি মন্ত্রণালয়। রোববার সংগঠনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার সই করা চিঠিতে বলা হয়, ৬ টাকা বাড়িয়ে এক লিটারের সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৫ টাকা, যা আগে ছিল ১৮৯ টাকা। ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ৯২২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে ৩৩ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম এখন ১৭৬ টাকা এবং প্রতি লিটার পাম তেলের দাম ১৬৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে কয়েক মাস ধরেই তেলের নতুন মূল্য সমন্বয়ের জন্য ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছিলেন। সবশেষ গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে এক চিঠি পাঠিয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, তারা প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৯ টাকা বাড়াবেন, যা গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে কার্যকরের কথা জানানো হয়। মূলত তাদের এসব তৎপরতা ছিল অনেকটাই একতরফাভাবে।
বাস্তবে বাণিজ্য উপদেষ্টার হুঁশিয়ারির কোনো বাস্তবায়ন নেই। বরং সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বাড়ানো দাম সমন্বয় করে কার্যকর করা হয়েছে।
এছাড়া গত কয়েকদিনের বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণেও দেখা যায়, নিত্যপণ্যের বাজারে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠলেও সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে ওই চক্রটি। রাজধানীর বাজারে দেখা যায়, হঠাৎ সরবরাহ কমে গত বুধবার থেকে পণ্যটির দাম বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দাম বেড়ে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি হয়। এতে টনক নড়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের। এরপর তড়িঘড়ি করে শনিবার রাতে পেঁয়াজের বাজার সহনীয় রাখতে আমদানির ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরপতন হয়। রোববার নাগাদ দাম কমলেও সোমবার থেকে ফের দাম ঊর্ধ্বমুখী লক্ষ্য করা গেছে।
সোমবার রাজধানীর বড় পাইকারি মার্কেট কারওয়ানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, আবারও বাজার থেকে পেঁয়াজ উধাও। আড়তগুলোতে কোনো পেঁয়াজ নেই।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী আশরাফ হোসেন সোমবার বিকেলে আমার দেশকে বলেন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ বিক্রি হলেও শনিবার ভোর থেকে রোববার নাগাদ চাহিদা কমে ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সোমবারের চিত্র ভিন্ন, এদিন চাহিদা বাড়লেও বাজারে পেঁয়াজ নেই।
তিনি বলেন, রোববার পেঁয়াজের ক্রেতা কম থাকায় সোমবার মোকামের বাজারে কৃষকরা পরিমাণে কম পেঁয়াজ নিয়ে আসেন। এতে চাহিদা বেড়ে মোকামেই দাম বেড়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা পেঁয়াজ পৌঁছাতে আরও ২ দিন লাগতে পারে। এ সুযোগে কিছু অসৎ ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছে।
কয়েকদিনের বাজারের উঠানামা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিপুল পরিমাণ নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার পাশাপাশি আমদানির খবরে শনিবার রাত থেকে দাম কমতে শুরু করে। রোববার দুপুর নাগাদ আগের দিনের তুলনায় পুরাতন পেঁয়াজ কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে ১০০ থেকে ১১০ টাকা হলেও নতুন পেঁয়াজের দাম অর্ধেকে নেমে এসে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু একদিনের ব্যবধানে ফের পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকার মতো বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবারও পেঁয়াজের দাম বাড়তির দিকে থাকতে পারে।
এছাড়াও গত দুই মাস ধরে কাঁচা মরিচ ও সবজির বাজারেও সক্রিয় ছিল কারসাজি চক্র। বিশেষ করে ৫০-৬০ টাকার কাঁচা মরিচ ৪০০ টাকা নাগাদ দাম ওঠানো হয়। বেশ কিছুদিন ২০০ টাকার ঘরেই অবস্থান করে পণ্যটি। যদিও বর্তমানে সরবরাহ বেড়ে ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে আমদানি করে স্থানীয় বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে ভোক্তাদের পকেট কেটে শত কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র। যথাযথ বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় দীর্ঘদিন থেকেই চলছে এ ধরনের কারসাজি।
সোমবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন আমার দেশকে বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজ না আসতেই একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম ৪০-৫০ টাকা কমে যাওয়া প্রমাণ করে যে, সিন্ডিকেট করে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছিল। এমনকি আমদানির অনুমতি না দেওয়া হলে পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা পার করানোর হুমকি দিয়েছিল ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ফলে সরকারের একটি সংস্থার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন, কৃষকের স্বার্থের কথা বলে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত।
হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক আমার দেশকে বলেন, খুবই দুঃখজনক; কৃষকের স্বার্থের কথা বলে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত থাকায় তারা সময়মতো পণ্য আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে তাদের গোপন আঁতাত রয়েছে। এর ফলে সাধারণ ভোক্তাকে ১৪০-১৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনে খেতে হচ্ছে। সময়মতো আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে ৪০ থেকে ৫০ টাকায় পেঁয়াজ কিনতে পারতো ভোক্তারা।
এদিকে প্রতি বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা তৈরি করেছে ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটির মতে, চার কারণে প্রতি বছর পেঁয়াজের দাম বাড়ে। প্রথমত, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য; দ্বিতীয়ত, পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাব; তৃতীয়ত, মৌসুমের শেষ পর্যায়; চতুর্থত, বৃষ্টিতে পেঁয়াজের ক্ষতি।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাবের) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, যথাযথ বাজার মনিটরিং এবং কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।
তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি—আইনের ব্যত্যয়। ভোক্তা স্বার্থ এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পদক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া মানে কারসাজি চক্রকে আরও সাহস দেওয়া। বাজার মনিটরিং ঠিকমতো হচ্ছে না এবং কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।