হোম > মতামত

কেমন হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি?

ড. মো. ফরিদ তালুকদার

ড. মো. ফরিদ তালুকদার

মধ্যপ্রাচ্য তার ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতি, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ধর্মীয় প্রভাবের কারণে একই সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল। এই অঞ্চল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর বৈদেশিক নীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তাই চলমান রাজনৈতিক ও একাডেমিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যনীতির সম্ভাব্য রূপ ও তার প্রভাব।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তখন থেকেই তার রাজনৈতিক দর্শন ও লক্ষ্য সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে, যা তিনি প্রতিফলিত করেছিলেন তার জনপ্রিয় স্লোগানে—‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতে, অতীতে আমেরিকা ছিল আরও শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী। নানা কারণে দেশটি সেই গৌরবময় অবস্থান থেকে পিছিয়ে পড়েছে। তাই তার লক্ষ্য হলো আমেরিকার হারানো গৌরব ও ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা।

এই ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার নীতি ছিল আমেরিকা ফার্স্ট (আমেরিকা প্রথম)। মানে সব কিছুর আগে আমেরিকাকে ও আমেরিকার স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। এই নীতিকে সামনে রেখে প্রথমবার তিনি আমেরিকার ফোকাস বিভিন্ন জায়গা থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মাধ্যমে আমেরিকাকে মহান (গ্রেট) করার কাজে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। আমেরিকা আগে সারা বিশ্বে তার মিত্র দেশের স্বার্থ গুরুত্বসহ প্রাধান্য দিত, এমনকি নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে সেই অবস্থা থেকে সরিয়ে এনে আমেরিকার স্বার্থ আগে দেখার নীতি গ্রহণ করেন। আর সেই নীতিই হলো ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি।

কিন্তু দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবার ভিন্ন ও আরও জটিল বৈশ্বিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও চলছে, সিরিয়ায় এখনও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে, যদিও বাশার আল-আসাদ পালিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক ভারসাম্যে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

এ কারণে এটা ধারণা করা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের নীতি থেকে কিছুটা সরে আসবেন। ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি থাকলেও আমেরিকাকে বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরিয়ে আনার পথে তিনি আগের মতো হাঁটবেন না। তিনি চাইবেন ‘আমেরিকা প্রথম’ এই নীতির পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা ধরে রাখতে।

তাই দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইলকে রাজি করাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘যদি চুক্তি না হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা হবে ভয়াবহ।’ ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি সম্পাদনে সরাসরি ভূমিকা পালনের মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চেয়েছেন।

প্রথমত, তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, এত বাধা অতিক্রম করে আগের চেয়েও বেশি শক্তি ও জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আবারও তিনি ক্ষমতায় ফিরছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি দেখাতে চেয়েছেন আমেরিকার ক্ষমতা এবং বোঝাতে চেয়েছেন এই যুদ্ধ বন্ধ করতে যে দেশ ভূমিকা রাখতে পারে তা হলো কেবল আমেরিকা।

এই চুক্তির তিনটি ধাপ আছে। প্রতিটি ধাপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে কি না, তা অবশ্যই আলোচনার বিষয়। তবে এই চুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। সৌদি আরব স্বাধীন ফিলিস্তিন চায়, কিন্তু তারপরও আমেরিকা ও ইসরাইলের যৌথ প্রচেষ্টায় সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার একটি লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। ২০২৩ সালে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলি যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়।

তাই এখন যদি ইসরাইলের যুদ্ধ থামানো যায়, তাহলে হয়তো সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সহজ হবে। পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসন চাইবে সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি (সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট) করতে। এই চুক্তি করতে সৌদি আরবের আগ্রহ আছে। এই চুক্তি হলে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সামরিক ক্ষমতা আরও বাড়বে এবং এতে সৌদি- ইসরাইলের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে আমেরিকা সৌদি আরবকে আরও বেশি প্রভাবিত করতে পারবে।

অন্যদিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সিরিয়া থেকে পালিয়ে গেছেন রাশিয়ায়। লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ইয়াহিয়া সিনাওয়ার এবং ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হয়েছেন।

এসব শীর্ষস্থানীয় নেতা, যারা সবাই ইরানের মিত্র ছিলেন, তারা হত্যার শিকার হওয়ায় এবং ওইসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে ইসরাইলকে চারপাশে ঘিরে রাখার যে কৌশল ইরান এত দিন অনুসরণ করত, ভবিষ্যতে সেটা কঠিন হবে। পাশাপাশি ইসরাইলি হামলায় হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিদের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে, লাগবে অনেক অর্থ, যা জোগান দেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা এই দেশগুলোর ও ইরানের নেই।

এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ আমেরিকার জন্য আরও সহজ ও বাস্তবায়নযোগ্য হয়ে উঠবে। আমরা দেখেছি, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে আব্রাহাম অ্যাকর্ড (Abraham Accord) চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে চারটি মুসলিম দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এই চারটি দেশ হলো বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুদান ও মরক্কো। আব্রাহাম অ্যাকর্ড নাম দেওয়া হয়েছে আমাদের হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নামে। কারণ মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি—এই তিন ধর্মের নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশ থেকে এসেছেন। এই চুক্তিতে যেহেতু তিন ধর্মের অনুসারী রাষ্ট্রই সই করেছে, তাই এই চুক্তির নাম দেওয়া হয়েছে আব্রাহাম অ্যাকর্ড ।

ট্রাম্প প্রশাসন এবার হয়তো ভিন্ন নামে আগের মতো চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝা দরকার। সুন্নিপ্রধান মুসলিম দেশগুলোর ওপর সৌদি আরবের শক্তিশালী প্রভাব আছে। পাশাপাশি সৌদি আরব মুসলমানদের পবিত্র ভূমি, যেখানে আছে কাবা শরিফ এবং নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র রওজা শরিফ। এ কারণে মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের অবস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। শুধু তা-ই নয়, সৌদি আরব তার শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়েও মুসলিম সুন্নিপ্রধান দেশগুলোর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইসলামিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই যদি সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়, তাহলে এই সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ইসরাইল এশিয়া ও আফ্রিকার আরও অনেক মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে।

পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসন ও ইসরাইল চাইবে নতুন কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়াসহ যেসব দেশে ইরানের প্রবল প্রভাব আছে, তাদের ওপর সহনীয় চাপ বজায় রেখে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে, যাতে করে ইসরাইল পুরোপুরিভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে আর তেমন বাধা না থাকে।

আর এটা যদি করা সম্ভব হয়, তাহলে একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্য পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে, অন্যদিকে আমেরিকা ও ইসরাইল মিলে এই অঞ্চলে ইরান, চীন ও রাশিয়ার প্রভাব ব্যাপকভাবে কমাতে সক্ষম হবে।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অব ম্যানেজমেন্ট

ম্যাকনিস স্টেট ইউনিভার্সিটি, লুইসিয়ানা, ইউএসএ

গেরুয়া বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে ভারতের সেনাবাহিনী

বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তকে কবর দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার

সংকটাপন্ন হাদি ও গুলিবিদ্ধ ভোটের তফসিল

শিক্ষা কমিশন গঠনের অপরিহার্যতা

মেগাসিটির বস্তিতে মেটা অগ্নিকাণ্ড এক অনন্তচক্র

সিলেট অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট

সেনাবাহিনী জনগণের, রাজনৈতিক দলের নয়

হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া: এক সতর্ক ঘণ্টা

রেমিট্যান্স বনাম মেধাপাচার

ভূরাজনীতি ও বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা