হোম > মতামত

নির্বাচনের সংস্কৃতি ও জনগণের আস্থাসংকট

আরিফুল ইসলাম রাফি

গণতন্ত্রের হৃদয় যদি হয় ভোটাধিকার, তবে নির্বাচনের সংস্কৃতি হলো সেই হৃদয়ের স্পন্দন। কিন্তু যখন সেই স্পন্দন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্র শুধু সংবিধানের একটি শব্দে পরিণত হয়। বাংলাদেশে আজ এমনই এক বাস্তবতা বিরাজ করছে; নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু আস্থা হারাচ্ছে, ভোটের আয়োজন হচ্ছে কিন্তু অংশগ্রহণের উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। এই আস্থা সংকটের কারণ, পরিণতি ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এখনই। কারণ গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি জনগণের বিশ্বাস ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাস একসময় ছিল গণআন্দোলনের প্রেরণা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় নির্বাচন ছিল উৎসবমুখর; মানুষ ভোট দিতে লাইনে দাঁড়াত গর্ব নিয়ে, দায়িত্ববোধ নিয়ে। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর দেশবাসী বিশ্বাস করেছিল, দুর্নীতি নয় দায়িত্বশীল রাজনীতি জন্ম নেবে।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশ্বাস ক্ষয়ে গেছে।

২০০১ সালের পর থেকে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই বিশ্বাসের ঘাটতি, সহিংসতা, অনিয়ম ও প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জনগণের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। আজ ভোটাররা ভোট দিতে যাওয়ার আগে ভাবে ‘আমার ভোটের কি কোনো দাম আছে?’

এই প্রশ্নটাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় সংকেত।

বাংলাদেশের নির্বাচন এখন অনেকাংশেই দলীয় প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে দলীয় প্রভাবের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ করছে আর বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

ফলাফল, জনগণের মনে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত অবিশ্বাসের সংস্কৃতি।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো প্রতিযোগিতা ও বিকল্প। কিন্তু যখন একটি দলের আধিপত্য দীর্ঘ সময় ধরে অটুট থাকে, তখন গণতন্ত্র ধীরে ধীরে রূপ নেয় একদলীয় নির্বাচনি ব্যবস্থায়, যেখানে অংশগ্রহণ থাকে, কিন্তু প্রতিযোগিতা হারিয়ে যায়। এ অবস্থায় নির্বাচনের ফল পূর্বনির্ধারিত মনে হলে জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারায়।

একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচন কমিশনকে প্রায়ই দেখা হয় কোনো এক পক্ষের হাতিয়ার হিসেবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া, আইনগত ক্ষমতা, মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণÑসবকিছুতেই দেখা যায় রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল বা প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে জনগণ মনে করে, ‘কমিশন নয়, রাজনৈতিক শক্তিই ঠিক করে কে জিতবে।’ এই অবিশ্বাস শুধু কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, বরং গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে।

একসময় ভোট ছিল এক ধরনের নাগরিক উচ্ছ্বাস।

আজ তা অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বা অর্থহীন কাজ।

ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার পেছনে আছে কয়েকটি মানসিক কারণÑ

ভোটকেন্দ্রে সহিংসতার আশঙ্কা, ভোট দিলেও ফল পরিবর্তন হবে না এমন বিশ্বাস, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গিয়ে জনকল্যাণ ভুলে যাওয়া, রাজনীতির সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের বিচ্ছিন্নতা। এভাবে ক্রমে তৈরি হচ্ছে অংশগ্রহণহীন গণতন্ত্র, যা দেখতে গণতান্ত্রিক হলেও ভেতরে ভেতরে শূন্য।

যখন মানুষ ভোটে বিশ্বাস হারায়, তখন তারা আইন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিও আস্থা হারায়। ফলে সমাজে বেড়ে যায় রাজনৈতিক উদাসীনতা, বিভাজন ও সহিংসতা।

গণতন্ত্র তখন হয়ে পড়ে শুধু আনুষ্ঠানিকতা;

আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা, না যে গণকেন্দ্রিক অংশগ্রহণ। আস্থা হারানো জনগণ আর প্রতিরোধ করে না, প্রশ্ন তোলে না, শুধু চুপচাপ দেখে যে গণতন্ত্রের জন্য তারা একসময় আন্দোলন করেছিল, সেটি ধীরে ধীরে প্রশাসনিক আয়োজনের রূপ নিচ্ছে।

আস্থাসংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্র এক কঠিন পরীক্ষার মুখে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাপিটল হিল হামলা, ভারতে নির্বাচনি ব্যয়ের অস্বচ্ছতা ও ধর্মীয় মেরূকরণ কিংবা ইউরোপে জনপ্রীতি রাজনীতির উত্থান; সবই ইঙ্গিত দিচ্ছে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হচ্ছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো যেখানে সংস্কার, স্বচ্ছতা ও নাগরিক শিক্ষা দিয়ে আস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে, বাংলাদেশে এখনো সেই সংস্কারের গতি ধীর।

গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়; এটি একটি চিন্তা, আচরণ ও মূল্যবোধের সংস্কৃতি। তাই নির্বাচনের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু নিয়ম নয়, মানসিক পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমনÑরাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া দরকার। কমিশনকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি নিরপেক্ষ থাকে, আস্থা ফিরবে দ্রুত। দলগুলোকে বুঝতে হবে, জনগণের আস্থা ছাড়া ক্ষমতার স্থায়িত্ব আসে না। প্রার্থীর যোগ্যতা, নীতি ও জনগণের অংশগ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে হবে। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাগরিক দায়িত্ববোধ ও গণতন্ত্রচর্চার শিক্ষা জরুরি।

নির্বাচন শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যম নয়; এটি জনগণের আস্থা যাচাইয়ের উৎসব। কিন্তু যখন জনগণ ভোটে বিশ্বাস হারায়, তখন রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। গণতন্ত্র টিকে থাকে শুধু সংবিধানে নয়; মানুষের মনে, বিশ্বাসে, আচরণে। আজ বাংলাদেশের প্রয়োজন একটাই; আস্থার পুনর্জাগরণ। যেদিন মানুষ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, যেদিন ফলাফল ঘোষণার আগেই জনগণ বিশ্বাস করবে তাদের ভোট গণ্য হয়েছে, সেদিনই সত্যিকারের গণতন্ত্রের জয় হবে। তার আগে পর্যন্ত আমাদের প্রশ্ন জারি রাখতে হবে, ‘নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু গণতন্ত্র কোথায়?’

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল : arifrafi1910@gmail.com

রপ্তানিতে দরকার বৈচিত্র্য

সামরিক শাসনের নতুন মডেল

বাক্সবন্দি নয়, দরকার দ্রুত বিচার

নিঝুম সন্ধ্যায় পথ ভুলে যাওয়া

বিডিআর হত্যাকাণ্ড : ভারত ও হাসিনার প্রতিশোধ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেষ জননন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া

গণতন্ত্র ধার করার প্রয়োজন নেই আফ্রিকার

ছয় কোটি নতুন মুখ দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকিতে কেন?

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ও বাস্তবতা

সংবিধানে ‘বিসমিল্লায় গলদ’