হোম > মতামত

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

ডা. মো. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ

ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিককালে ঢাকায় ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনা আমাদের আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ একটি এলাকায় অবস্থিত। ভূতাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণে, যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের ভূমিকম্পের সম্মুখীন হওয়া আমাদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা রোধ করা সম্ভব নয়, তবে সঠিক প্রস্তুতি ও সচেতনতা অবলম্বন করে এর ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির সংখ্যা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। জীবন বাঁচাতে এই তিনটি ধাপে (আগে, চলাকালীন এবং পরে) আমাদের কী কী করণীয়, তা প্রতিটি নাগরিকের জেনে রাখা অত্যাবশ্যক।

প্রথম ধাপ : ভূমিকম্পের আগে প্রস্তুতি

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো এর আগে। আপনার সামান্য প্রস্তুতি আপনার এবং আপনার পরিবারের জীবন রক্ষা করতে পারে।

১. জরুরি কিট তৈরি : একটি সহজে বহনযোগ্য ব্যাগে অন্তত ৭২ ঘণ্টার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন। এই কিটে থাকবে—

পানি ও শুকনো খাবার : সহজে নষ্ট হয় না এমন খাবার (যেমন : বিস্কুট, চিড়া ও গুড়) এবং পর্যাপ্ত খাবার পানি।

  • প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম : ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, কাঁচি, প্যারাসিটামল এবং পরিবারের প্রয়োজনীয় ওষুধ।
  • যোগাযোগ ও আলো : ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট, অতিরিক্ত ব্যাটারি, হুইসেল (ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে গেলে সংকেত দেওয়ার জন্য) এবং চার্জ করা পাওয়ার ব্যাংকসহ একটি সাধারণ রেডিও।
  • অন্যান্য : গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র (পরিচয়পত্র, প্রেসক্রিপশন ইত্যাদির ফটোকপি), নগদ টাকা, চাবির সেট এবং একটি ফাস্ট এইড বই।
  • জরুরি কিটটি বাড়ির এমন স্থানে রাখুন, যেখানে ভূমিকম্পের পরও সহজে পৌঁছানো যায় (যেমন : দরজার কাছে বা প্রধান কক্ষের কোণে)।

২. ঘরোয়া ঝুঁকি হ্রাস

ভারী আসবাবপত্র সুরক্ষিত করুন : লম্বা আলমারি, বুকশেলফ বা অন্যান্য ভারী আসবাবপত্র দেয়ালের সঙ্গে শক্তভাবে বেঁধে রাখুন, যাতে সেগুলো উল্টে না যায়। এর জন্য অ্যাঙ্গেল বন্ধনি (angle brackets) ব্যবহার করা যেতে পারে।

  • ঝুঁকিযুক্ত স্থান থেকে দূরে সরান : বিছানার কাছাকাছি বা বসার জায়গায় উপর থেকে পড়তে পারে এমন ভারী ফ্রেম, কাচের জিনিস বা ছবি সরিয়ে ফেলুন।
  • নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করুন : আপনার বাড়ির মধ্যে কোথায় কোথায় আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে (যেমন : মজবুত টেবিলের নিচে বা বাড়ির ভেতরের কোনো শক্তিশালী দেয়ালের পাশে) তা পরিবারের সবাই মিলে চিহ্নিত করুন।
  • গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ : ভূমিকম্পের সময় দ্রুত গ্যাস ও বিদ্যুতের মেইন সুইচ কোথায় বন্ধ করতে হয়, তা পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের ভালো করে শিখিয়ে দিন।

৩. পারিবারিক পরিকল্পনা

  • ভূমিকম্প হলে বাড়ির বাইরে কোথায় সবাই মিলিত হবে, সেই স্থানটি আগে থেকে ঠিক করে রাখুন। এটিকে ‘ফ্যামিলি মিটিং পয়েন্ট’ বলা হয়।
  • যদি পরিবারের কেউ বাড়ি থেকে দূরে থাকে, তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা তৃতীয় কোনো আত্মীয়ের ফোন নম্বর ঠিক করে রাখুন।

দ্বিতীয় ধাপ : ভূমিকম্প চলাকালীন করণীয়

ভূমিকম্প শুরু হলে আপনার প্রতিটি সেকেন্ড জরুরি। এ সময় আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া আবশ্যক। মনে রাখবেন, বেশির ভাগ আঘাত ঘটে ঘরের ভেতরে ভেঙে পড়া জিনিস বা কাচের কারণে।

১. ‘নুইয়ে পড়ুন, আড়াল নিন, ধরে থাকুন’ (Drop, Cover, and Hold On) : এটিই ভূমিকম্পের সময় নিজেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।

  • নুইয়ে পড়ুন (Drop) : সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ুন।
  • আড়াল নিন (Cover) : আপনার মাথা ও ঘাড়কে কোনো মজবুত টেবিল, ডেস্ক বা অন্য কোনো শক্ত আসবাবপত্রের নিচে আড়াল করে দিন। যদি কাছাকাছি কোনো আড়াল না থাকে, তাহলে একটি ভেতরের দেয়ালের পাশে মেঝেতে উপুড় হয়ে দুহাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখুন।
  • ধরে থাকুন (Hold On) : আড়াল নেওয়া আসবাবপত্রটিকে শক্তভাবে ধরে থাকুন, যাতে কম্পনের সময় সেটি সরে গেলেও আপনি তার সঙ্গে সুরক্ষিত থাকেন। কম্পন পুরোপুরি না থামা পর্যন্ত সেখানেই স্থির থাকুন।

২. ভেতরের সতর্কতা

  • জানালার কাচ, বাইরের দেয়াল এবং যেকোনো ভারী আসবাবপত্র, যা উল্টে যেতে পারে, সেগুলো থেকে দূরে থাকুন।
  • দৌড়ে বাইরে বের হবেন না। মনে রাখবেন, সিঁড়ি বা লিফটে ওঠানামার সময় কাঠামো দ্রুত ধসে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কখনোই লিফট ব্যবহার করবেন না।
  • যদি রান্নাঘরে থাকেন, দ্রুত চুলা বা গ্যাসের লাইন বন্ধ করার চেষ্টা করুন এবং সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় নিন।

৩. বাইরে থাকলে

  • ভবন, গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, ওভারপাস বা রাস্তার বাতি থেকে দূরে সরে গিয়ে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।
  • মাথা রক্ষা করতে ব্যাগ বা হাত ব্যবহার করুন।

৪. গাড়িতে থাকলে

  • একটি নিরাপদ, খোলা জায়গায় ধীরে ধীরে গাড়ি থামান।
  • ভূমিকম্প না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই থাকুন। গাড়ি থামানোর সময় ওভারপাস, গাছ বা ল্যাম্পপোস্ট থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।

তৃতীয় ধাপ : ভূমিকম্পের পরে করণীয়

কম্পন থেমে গেলেই বিপদ পুরোপুরি কেটে যায় না। আফটারশক বা পরবর্তী কম্পন যে কোনো সময় আসতে পারে।

১. নিজেকে পরীক্ষা করুন ও সাহায্য করুন

  • ধীরে এবং সাবধানে আপনার আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে আসুন।
  • নিজেকে পরীক্ষা করুন, আঘাত পেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিন। যদি সম্ভব হয়, অন্য আহতদের সাহায্য করুন।

২. আগুন ও গ্যাস সম্পর্কে সতর্ক থাকুন

  • গ্যাসের গন্ধ পেলে বা কোনো ফাটল দেখলে দ্রুত প্রধান গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিন। আগুনের কোনো চিহ্ন দেখলে দ্রুত নেভানোর চেষ্টা করুন বা ফায়ার সার্ভিসকে জানান।
  • বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা ভাঙা তার দেখলে, মেইন বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিন।

৩. ধ্বংসস্তূপ থেকে সাবধান

  • ভাঙা কাচ, আলগা ইট বা পড়ে যাওয়া তারের কারণে খালি পায়ে হাঁটবেন না। মোটা জুতো পরিধান করুন।
  • যদি কোনো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হয়, তবে সেখানে প্রবেশ করবেন না, দ্রুত সেখান থেকে দূরে সরে যান।

৪. যোগাযোগ ব্যবস্থা

  • টেলিফোন লাইন শুধু জরুরি অবস্থার জন্য ব্যবহার করুন। সাধারণ যোগাযোগের জন্য টেক্সট মেসেজ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করুন, যাতে জরুরি পরিষেবার জন্য ফোন লাইন ব্যস্ত না হয়।
  • রেডিও বা টেলিভিশনে স্থানীয় ও সরকারি জরুরি নির্দেশাবলি মনোযোগ দিয়ে শুনুন। গুজবে কান দেবেন না।

৫. আফটারশক (Aftershocks)

  • ভূমিকম্পের পর প্রায়ই আফটারশক আসে। তাই প্রস্তুত থাকুন এবং প্রতিটি আফটারশকের সময় আবার ‘নুইয়ে পড়ুন, আড়াল নিন, ধরে থাকুন’ কৌশলটি অবলম্বন করুন।

ভূমিকম্প এক চরম বাস্তবতা। কিন্তু এর মোকাবিলা করার সাহস ও প্রস্তুতি আমাদের হাতেই। আতঙ্কিত না হয়ে, এই নির্দেশিকাগুলো মেনে চললে আপনি শুধু নিজের জীবনই রক্ষা করবেন না, আপনার পরিবার এবং প্রতিবেশীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন। মনে রাখবেন, ভূমিকম্প থামে, কিন্তু সতর্কতা থামে না। প্রস্তুত থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন), জেরিয়াট্রিশিয়ান, প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্পেশালিস্ট, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

স্বৈরশাসকদের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন

যুদ্ধের নীরব অস্ত্র যৌন নিপীড়ন

ভূমিকম্পের মাত্রা যদি আরেকটু বেশি হতো!

পাহাড়ে নতুন ষড়যন্ত্র

বিনোদনের বিপ্লব ও জেন-জি সংস্কৃতি

বামপন্থা ও স্বৈরাচার

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের দ্বিধা

ভোট কারচুপি রোধে প্রয়োজন সিসি ক্যামেরা