হোম > মতামত

দিল্লির বিবৃতি ও বাস্তবতা

এলাহী নেওয়াজ খান

সম্প্রতি দিল্লির একটি বিবৃতি আমাদের দৃষ্টি দারুণভাবে কেড়ে নিয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের সব আবেদন-নিবেদন ক্রমাগত অগ্রাহ্য করার পর এই বিবৃতি বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। ১৪ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ভারত কখনো তার ভূখণ্ডকে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করতে দেয়নি। দিল্লির এই বক্তব্য কতটা সত্য, তা অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দিল্লির ওই বক্তব্য সত্য হলে বাংলাদেশে ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে একই রকম থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা কখনো থাকেনি, বরং নানা উপায়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের হস্তক্ষেপের ফলে বারবার সম্পর্ক তিক্ততায় পরিণত হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হওয়ার পরও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আন্তরিকতা ও সততার উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বরং কখনো কখনো এ সম্পর্ক এতটাই তিক্ততায় পরিণত হয়েছে, যা কখনোই দুদেশের জনগণের কাম্য ছিল না। মূলত ভারতের শাসক চক্রের ক্রমাগত আগ্রাসী মনোভাবের কারণে এই সম্পর্ক কখনোই কাঙ্ক্ষিত মর্যাদাপূর্ণ স্তরে উপনীত হয়নি।

যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলে এ সম্পর্ককে মধুর হিসেবে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখবেন, এ সম্পর্ক প্রভু ও গোলামের সম্পর্ক, সমমর্যাদাপূর্ণ নয়। বিষয়টি এ রকম তুমিÑ(ভারত) আমাকে ক্ষমতায় রাখো, আমি তোমার সব চাহিদা পূর্ণ করব। যেমনটা একবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি ভারত সারাজীবন মনে রাখবে, প্রতিদানের কী আছে।’ আসলে গোলাম কখনো প্রতিদান চায় না, সে শুধু চায় প্রভুর সুনজর ও অনুকম্পা।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন আমল ঠিক সে রকমটাই ছিল। জুলাই গণবিপ্লবে পরাজিত শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর প্রভুর অনুকম্পার বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেখানে তিনি এবং তার দলের নেতাকর্মীরা অনেকটা জামাই আদরেই আশ্রয় পেয়েছেন। এদিক দিয়ে বিচার করলে ভারত বিপদে তার অনুগতদের সাহায্য করতে কূটনৈতিক বিপর্যয়ে পড়লেও ঝুঁকি নিতে দ্বিধাবোধ করে না। এটাও ভারতের কম উদারতা নয়। সে তার অনুগতদের কখনোই পরিত্যাগ করে না। সেটা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে করেনি, এখনো করছে না।

অন্যভাবে বলা যায়, ভারত তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের পাত্তা না দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে আসছে শুরু থেকেই। এমনকি কখনো ছলেবলে-কৌশলে কিংবা কখনো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও দুর্বল স্বাধীন দেশগুলো দখল করে নিতেও সে দ্বিধাবোধ করে না। যেমন : ১৯৭৫ সালে ভারত সিকিমকে দখল করে নিয়েছিল। যেমনটা হয়েছিল মনিপুর ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রে। হায়দারাবাদ ও জুনাগড়ের মতো করদরাজ্যগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। অন্যদিকে অন্যান্য ক্ষুদ্র সার্বভৌম প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি আগাগোড়া কেমন ছিল, তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে, ক্রমান্বয়ে সম্পর্কের ক্রমবনতি।

যে দেশটির সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে সুন্দর ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল, সেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের শুধু উত্থান-পতনের ঘটনাই ঘটেনি; বরং অনেকবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেছে অনেকবার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা দুদেশের সম্পর্ককে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারত। সে সময় এ দেশের মানুষ বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু পরে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা সম্পর্ককে আনুগত্যের মড়োকে বিবেচনা করতে গিয়ে যে ভুল পথ ধরেছিল, তা থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

গোড়া থেকেই ভারত বাংলাদেশের জনগণকে বিবেচনায় না রেখে শুধু আওয়ামী লীগ ও তার সমগোত্রীয় কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে একান্তভাবে ভারতের অনুগত ভাবায় সম্পর্কের টানাপোড়েন লেগেই ছিল। যেমন করে ভারত শুধু নেপাল কংগ্রেসকে তার একমাত্র অনুগত দল হিসেবে বিবেচনা করায় সামগ্রিকভাবে দীর্ঘ মেয়াদে নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যেটা তারা বাংলাদেশে অনুসরণ করেছে। যার ফল হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের শাসক চক্রের দূরত্ব শুধু বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।

নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র এক বছরের মাথায় কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনী তৎপরতা শুরু করেছিল। সেটি ছিল ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাস। সময় থেকে একটি স্বাধীন জুমল্যান্ড সৃষ্টির লক্ষ্যে শান্তিবাহিনী তৎপরতা শুরু করে, যা কয়েক বছরের মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। এই শান্তিবাহিনী গঠন, প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্র সরবরাহÑসবটাই করেছিল ভারত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুধু শান্তিবাহিনী নয়, আরেকটি রাজনৈতিক গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত করা হয়েছিল। সেই গ্রুপটি ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রুপ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তারা সেখান থেকে বাংলাদেশে ঢুকে গেরিলা তৎপরতা শুরু করেছিল। তারা বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং সেসব যুদ্ধে একডজনের বেশি বাংলাদেশের সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, আশির দশকে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র হামলা ভয়াবহ আকার লাভ করেছিল। ঠিক সেই একই সময়ে ভারতের সহায়তায় শ্রীলঙ্কায় এলটিটির সশস্ত্র আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। সুতরাং এ কথা বলার অবকাশ নেই যে, ভারত কখনোই বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার জন্য তার ভূখণ্ডকে ব্যবহার করতে দেয়নি।

বর্তমানে আরেকটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অর্থাৎ জুলাই বিপ্লবের পর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতা ও কর্মী বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে বসে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য সৃষ্টির উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি কোনো কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আশ্রয় নেওয়া অনেক নেতাকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হচ্ছে।

সর্বশেষ ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যা প্রচেষ্টাকারী সেই যুবক ফয়সাল ও তার সহযোগী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবর যদি সত্য হয় এবং ভারত যদি তাদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, তাহলে বোঝা যাবে দিল্লির বিবৃতিটা কতটা সত্য কিংবা কতটা কথার অলংকার মাত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে পলাতক অপরাধীদের খুনিদের ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে ভারতের কোনো আগ্রহ নেই। উল্টো আমরা দেখলাম, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে।

ভারতকে বুঝতে হবে বাংলাদেশে হত্যা, গুম ও খুনের সঙ্গে অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যখন নিরাপদ আশ্রয়ে ভারতে থাকে, তখন এ দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ওসমান হাদি হত্যার পর জুলাই আন্দোলনের ছাত্রনেতারা ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করেছেন। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছেন। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন অপরাধীদের ফেরত দেওয়ার। না হলে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ আরো বাড়বে।

ভারতের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে প্রতিবেশী বদলানো যায় না। কোনো দেশের সরকার স্থায়ী নয়। ভারত সরকার আওয়ামী লীগের মতো একটি নিপীড়ক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিল কিন্তু এ দেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেনি। ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা বোঝার চেষ্টা করা। ভারতে বসে আওয়ামী লীগ নেতাদের যেকোনো ধরনের তৎপরতা বন্ধ করা। হাসিনা-কামালসহ বাংলাদেশের আদালতে যাদের বিচার হয়েছে, তাদের ফেরত দেওয়া। আর কোনো অপরাধী যাতে ভারতে নিরাপদ আশ্রয় না পায়, তা নিশ্চিত করা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে শুধু দুদেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ওসমান হাদি : শহীদের রক্তে থামে না বিপ্লব

সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার ঘাটতি : মৎস্য উন্নয়নের বাধা

পানি ঘোলা করে দিন, পরাজিত শক্তি আরো শিকার করুক!

হাদির মৃত্যুমঞ্চ তৈরি করল কারা

সত্য উচ্চারণে একটি সাহসী কণ্ঠের বিদায়

হাদি মরেনি—আমরাই মরছি প্রতিদিন

ইসলামি রাজনীতি না ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র

হাদি, ইসকন ও একজন শাহেদ আলম

গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র, ২১ শতকের বাস্তব চিত্র

অতিথি পাখি নিরাপদে থাকুক