গাজায় যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব হামাস মেনে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার মিসরে ইসরাইলের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এরপর থেকেই গাজার ফিলিস্তিনিরা আনন্দে ভাসছেন। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এমন এক চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি দখলদার ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার, মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও বন্দিবিনিময়ের পথ সুগম করবে। সংগঠনটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তিনি যেন ইসরাইলকে কোনোভাবেই এই চুক্তি এড়িয়ে যাওয়ার বা বিলম্ব করার সুযোগ না দেন এবং চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে বাধ্য করেন।
এর আগে বুধবার ট্রাম্প জানান, গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তি-সংক্রান্ত তার ২০ দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে একমত হয়েছে হামাস ও ইসরাইল। তিনি তার ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে লেখেন, ‘আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, ইসরাইল ও হামাস আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির বিশ্লেষকরা যখন ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবকে ইসরাইলের জন্য শতভাগ সুবিধা দেওয়ার একটি উদ্যোগ হিসেবে অভিহিত করছেন, তখন হামাস কেন ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব মেনে নিল? তাদের লক্ষ্য কী? ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী সংগঠনটি কি অস্ত্র সমর্পণ করবে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় একটি ব্যাপক যুদ্ধবিরতি কার্যকর, গাজা থেকে ইসরাইলি বন্দিদের ফিরিয়ে আনা, হামাসের সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দেওয়া এবং গাজায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু এই পরিকল্পনার প্রতি হামাসের প্রতিক্রিয়া, তাদের কৌশলগত হিসাবনিকাশ এবং ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কী হবে, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মৌলিক কিছু বাধা বা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
কিন্তু তারপরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে ট্রাম্পের প্রস্তাব নীতিগতভাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে হামাস। বিশ্লেষকদের অভিমত এবং ফিলিস্তিনের বিভিন্ন উপদলের নেতাদের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ আরব, তা থেকে ট্রাম্পের প্রস্তাব হামাসের মেনে নেওয়ার মূল কারণগুলো উঠে এসেছে।
অধিকৃত পশ্চিমতীরভিত্তিক ফিলিস্তিনি সংগঠন ফাতাহর মুখপাত্র আবদেল ফাতাহ দাওলা বলেন, ‘এই মুহূর্তে হামাস যেসব কারণে ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তা বহুমুখী।’ তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির যেসব লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা হামাসকে একটি গ্রহণযোগ্য আলোচনাকারী পক্ষ থেকে চাপের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে ট্রাম্পের সরাসরি হুমকি দেওয়ার বিষয়টিও উপেক্ষা করার মতো নয়। কারণ ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তার প্রস্তাব হামাস প্রত্যাখ্যান করলে তা নেতানিয়াহুকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে গাজার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে।’
গাজার চরম মানবিক বিপর্যয়ও এই যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে হামাসকে। কারণ দুই বছরের যুদ্ধে গাজা উপত্যকার সব অবকাঠামো, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মুরাদ হারফুস বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ক্ষমতার ভারসাম্যকে বদলে দিয়েছে। ইসরাইলি হামলায় গাজার অধিকাংশ শহর ধ্বংস হয়েছে এবং হামাসের অনেক সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা শহীদ হয়েছেন। এটি হামাসের ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে, যা যুদ্ধ বন্ধ করতে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের দিকে ঠেলে দেয় সংগঠনটিকে।’
হারফুস বলেন, ‘আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং হিসাবনিকাশও অনেকটাই হামাসের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক ফ্রন্টগুলো, বিশেষ করে হিজবুল্লাহর ভূমিকা হ্রাস পাওয়া হামাসের দরকষাকষির অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই চাপের ফলে হামাস তার অবস্থানে পরিবর্তন দেখেছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কিছু পরিবর্তিত বিষয়ও অনেক ক্ষেত্রেই হামাসের পক্ষে ছিল না।’
অন্যদিকে, হামাস ২০ দফা চুক্তিটি গ্রহণ না করলে তারা ‘সম্পূর্ণ নরকের’ মুখোমুখি হবে বলে ট্রাম্পের হুমকি এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার হামাসের কাছে যুদ্ধ বন্ধের বিকল্প পথ বা উপায়গুলোকে সীমিত করে এনেছিল।
ইসরাইল গত মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে গাজা শহরকে ঘিরে ফেলার জন্য ‘গিডিয়নের রথ ২’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে নির্বিচার বোমাবর্ষণ করা হয়, ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হয় আবাসিক ভবনগুলো। এতে মানবিক পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণে দশ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি তাদের আশ্রয় হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হন। এই ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা ঠেকানোর কোনো ক্ষমতা হামাসের ছিল না।
ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের প্রতি হামাসের ইতিবাচক মনোভাব ফিলিস্তিনি রাজনীতি এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের বৃহত্তর কাঠামোতে সংগঠনটির অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন আনার বা পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। হামাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য নিউ আরবকে বলেন, ‘হামাস এটি বুঝতে পেরেছে, অস্ত্র ধরে রাখার অর্থই হচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নিজের প্রভাব হারানো।’ তিনি আরো বলেন, ‘হামাস এখন নিরস্ত্রীকরণের আলোচনায় ফিলিস্তিনি অন্যান্য সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করাসহ এই আলোচনাকে বৃহত্তর জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।’
অধিকৃত পশ্চিমতীরের বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডক্টর আলী আল-জারবাবি মনে করেন, ট্রাম্পের অস্ত্রবিরতি চুক্তি নিয়ে হামাসের সামনে বিকল্প চিন্তা করার পথ খুব বেশি ছিল না। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ করার বিকল্প পন্থাগুলো ছিল একেবারেই সীমিত। কারণ হামাস বেশ কয়েকটি পক্ষের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছিল। প্রস্তাব মেনে নিয়ে তারা সেই চাপ যেমন কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, তেমনি এই চুক্তির মাধ্যমে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার আশঙ্কারও অবসান ঘটেছে।’
আল-জারবাবির মতে, হামাসকে এখন অবশ্যই তাদের ‘নিরাপদ প্রস্থানের বিকল্পগুলো বিবেচনা করতে হবে। যারা গাজা ছেড়ে যেতে চান, তারা তা করতে পারেন আর যারা থাকতে চান, তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে ‘ইতিবাচক কিছু বিষয় আছে যা ভবিষ্যতের সমাধানের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করবে, যদিও এটি অর্জনের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালাতে হবে।’
বিশ্লেষক ড. মুরাদ হারফুস বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠী, আরব মিত্র এবং আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে ট্রাম্পের প্রস্তাব নিয়ে পরামর্শের পর হামাস ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। হামাসের এই অবস্থানকে অধিকাংশ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী স্বাগত জানিয়েছে, কারণ তাদের এই অবস্থান একটি দায়িত্বশীল প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, যা জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অভ্যন্তরীণ সংলাপের কাঠামোতে ফিরিয়ে আনবে।
এই শান্তিচুক্তি আগামী দিনে ফিলিস্তিনিদের একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পথ তৈরি করতে পারে। মিসর ইতোমধ্যেই সব ফিলিস্তিনি দল ও সংগঠনকে নিয়ে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানে একটি সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সম্মেলন ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জাতীয় দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক অংশীদারত্বের প্রতি অঙ্গীকার পূরণের একটি সম্ভাব্য সুযোগ তৈরি করবে।
হামাসের অস্ত্র ইস্যুটি এখনো সবচেয়ে সংবেদনশীল একটি বিষয়। ট্রাম্পের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় হামাস তাদের অস্ত্রের প্রসঙ্গ নিয়ে সরাসরি কিছু বলেনি। তবে তারা জানিয়েছে, তাদের অস্ত্র হলো একটি ‘রেডলাইন’ বা চীড়ান্ত রেখা, যা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত স্পর্শ করা যাবে না।
এ সম্পর্কে আল-জারবাবি বলেন, ‘হামাসকে এখন অনুধাবন করতে হবে যে, ইসরাইলের জন্য হুমকি হিসেবে তারা আর অস্ত্র ধারণ করতে পারবে না। সংগঠনটি আক্রমণাত্মক অস্ত্র ত্যাগ করার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে, তবে ব্যক্তিগত অস্ত্র ধরে রাখবে তারা। অস্ত্র ত্যাগের বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে আলোচনায় ঐকমত্য হয় কি না সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে, বিশ্লেষক হারফুস বলেন, ‘হামাসের বিশাল অস্ত্রাগার থাকার বিষয়টি অতিরঞ্জিত, কারণ তাদের কাছে স্থানীয়ভাবে তৈরি ব্যক্তিগত এবং সাধারণ অস্ত্র আছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডক্টর আশরাফ আক্কা হামাসের সামনে বাস্তব প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধের পর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ হামাসের অবস্থানকে প্রভাবিত করবে। তবে এই চাপ সত্ত্বেও সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হামাসের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও তৈরি হবে।’
আগামী দিনে হামাস সশস্ত্র সংগঠন থেকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হবে কি না এবং এর নামেও কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সংগঠনটির মধ্যে। মোটকথা, হামাসের সামনে এখন নানামুখী সংকট ও সম্ভাবনা দুটোই আছে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার শর্তগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে তা কতটুকু মেনে চলবে, তার ওপরই এর সফলতা নির্ভর করছে।