হোম > মতামত

নির্বাচনি মিত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী

আলফাজ আনাম

আলফাজ আনাম

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভোটের ট্রেন চলতে শুরু করল। বাধাহীন নির্বাচনি কার্যক্রম শেষ হতে আরো কিছু পথ অতিক্রম করতে হবে। বিএনপি মনোনীত পদপ্রার্থীদের যে নাম প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়ে, জরিপের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন যে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা বিবেচনায় রেখে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বের মুখ হিসেবে দৃশ্যপটে থাকছেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি এবারও তিনটি আসনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। দিনাজপুর-৩, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১ আসনে।

১৯৯১ সালে নির্বাচনি রাজনীতি শুরু হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া কোনো আসনে পরাজিত হননি। একই সঙ্গে তিনি প্রার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। শুধু রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে নন, তার অবস্থান জাতির অভিভাবকের পর্যায়ে। বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার দল বিজয়ী হলে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে, যা জাতির জন্য ছিল আশাবাদী হওয়ার মতো খবর। নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে বিএনপি নেতাকর্মীদের দারুণভাবে উজ্জীবিত করবে।

বিএনপি শরিক দলগুলোর জন্য ৬৩টি আসন ছেড়েছে। অতীতে বিএনপি চারদলীয় জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হলেও এত আসন ছাড়তে হয়নি। জামায়াতে ইসলামীর মতো বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জামায়াতকে ৩০টির কম আসন ছেড়েছিল। কিন্তু এবার অনেক ছোট দলের জন্য বিএনপি বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে। ঢাকাকেন্দ্রিক ছোট দলের বড় নেতারা প্রায় সবাই বিএনপির সমর্থন নিয়ে এবার নির্বাচনের মাঠে থাকবেন। তবে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের কারণে নিবন্ধন পাওয়া দলের নেতারা জোটের প্রধান দলের প্রতীক বা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। নিবন্ধন নেওয়ার সময় যে প্রতীক তারা পেয়েছেন, সেই প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ এবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি আসন সমঝোতা হলেও, প্রার্থীরা জোটবদ্ধভাবে এক প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবেন না। এর ফলে ভোটের হিসাবনিকাশ আরো জটিল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক প্রেক্ষাপটে এবার রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা অংশ নিচ্ছেন। এরশাদের পতন-পরবর্তী নির্বাচনি রাজনীতি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে আসা জোট এবং ভোটের রাজনীতির অবসান ঘটেছে। বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এখন বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মিত্রতার বন্ধনে থাকা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয় দলের জন্য এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চার কোটির বেশি তরুণ ভোটার। যারা প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ- বিএনপি বাইনারির বাইরে ভোট দিতে যাচ্ছেন। তারা সম্ভবত মার্কার চেয়ে প্রার্থী দেখে এবার ভোট দেবেন। ফলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে।

ভোটারদের পছন্দ-অপছন্দ বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো এবার প্রার্থী নির্বাচন করতে মনোযোগী হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির অভিযোগ, কালো টাকার মালিক কিংবা ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখা যাচ্ছে না। এমনকি বিএনপির প্রার্থী তালিকায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সামনের সারির পরিচিত মুখ বাদ পড়েছেন। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলের গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনার সঙ্গে গোপনে কিছু প্রভাবশালী নেতার সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে ধারণা করা হয়। সম্ভবত, এসব অভিযোগ আমলে নিয়েও বেশ কিছু নেতাকে এবার প্রার্থী হিসেবে রাখা হয়নি।

বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনে আরেকটি বিষয় অনেকের দৃষ্টি এড়ায়নি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর বিএনপি ভেঙে আরেকটি বিএনপি গড়ার সঙ্গে জড়িত অনেক নেতা এবার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন। সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত অন্তত ১৪ জন নেতা এবার প্রার্থী হিসেবে টিকিট পেয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে হয়তো তাদের অতীত অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে বলে মনে করা যায়। তবে বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘বিশ্বাসঘাতক’ নেতাদের বহিষ্কার কিংবা দলত্যাগ এবং সুসময়ে আবার দলে ফিরে আসার বহু নজির রয়েছে। ফলে বিএনপির রাজনীতিতে এটি অস্বাভাবিক বিষয় না হলেও ভবিষ্যতে যে দলটি এ ধরনের রাজনীতিকদের মাধ্যমে বিপর্যয়ে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বিএনপিতে ইসলামি মূল্যবোধের ডান ও সেক্যুলার বাম বলয়ের নেতাদের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় থেকে বিএনপির রাজনীতি এভাবেই আবর্তিত হয়েছে। ইসলামি মূল্যবোধের ওপর জিয়াউর রহমান বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপিতে এখন ডান বলয়ের প্রভাব সীমিত হয়ে পড়েছে এবং সেক্যুলার বাম বলয়ের নেতাদের প্রভাব বেড়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দল ভাঙার সঙ্গে জড়িত নেতাদের প্রায় সবাই ছিল সেক্যুলার বাম বলয়ের।

বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিকসচেতন মানুষের কাছে প্রশ্ন ছিল বিএনপির ছেড়ে দেওয়া এই আসনগুলোর মধ্যে ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির জন্য কোনো আসন ছাড় দেওয়া হয়েছে কি না? বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিএনপির ছাড় দেওয়া আসনগুলোর বিশ্লেষণ ও এনসিপির নানা সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে এনসিপির আসন বণ্টন অনেকটা নিশ্চিত। এনসিপির দিক থেকে বেশিসংখ্যক আসন পাওয়ার জন্য দরকষাকষির চেষ্টা করা হবে বলে মনে হয়। তবে বিএনপি মহাসচিব জানিয়েছেন, যে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না। অর্থাৎ এনসিপির জন্য বিএনপি নির্দিষ্ট আসন ছাড় দিয়ে তালিকা প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনি সমঝোতায় ইসলামপন্থি দলগুলো এবার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। বিএনপির সঙ্গে বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থি দলের আসন সমঝোতা হয়েছে। এসব দলের পক্ষ থেকে প্রায় ১০টির মতো আসন ছেড়ে দিতে হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান দৃঢ় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও আটটি ইসলামপন্থি দল আসন সমঝোতার জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে। যার মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও খেলাফত মজলিসের মতো দল রয়েছে। উভয় রাজনৈতিক জোটের মধ্যে ইসলামপন্থি দলের অংশগ্রহণ থাকছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থিদের ভারসাম্যপূর্ণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখতে পারে।

বিএনপি এমন একসময় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে, যখন জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় আকারে বিভেদ দেখা দিয়েছে। উচ্চকক্ষে ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে আসনবণ্টন ও গণভোট নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভিন্নতা তীব্র আকার ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে সরকার এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলো চাইছে সরকার রেফারির ভূমিকা পালন করুক। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে বল ছুড়ে দিয়েছে।

সরকারের এই কঠোর অবস্থানের পর মনে হচ্ছে বিরোধপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক কালোমেঘ কেটে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপি সম্ভবত উচ্চকক্ষে ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে আনুপাতিক আসন বণ্টনের বিষয়টি মেনে নেবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি থেকে সরে এসে একই দিনে গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।

সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করে নির্বাচনি আমেজ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতার কারণে অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল। বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সন্দেহের অনেকটা অবসান হয়েছে।

বিএনপির এই প্রার্থী ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করল। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা দাবি করতেন, পতিত দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া নাকি বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। এমনকি তাদের আশ্রয়দাতা দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করে আসছে। তাদের এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অর্থ যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী জাতীয় পার্টিকে বোঝায়, এ দেশের মানুষ তা সহজে বুঝতে পারছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর সারা দেশে উল্লাস ও মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ থেকে বোঝা যায় নির্বাচন কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের দুঃশাসনে দেশের মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়েছিল, সেই অধিকার তারা ফিরে পেতে যাচ্ছে। বহুদলীয় রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী দলের যে কোনো অবস্থান নেই, নির্বাচনি উৎসবের আমেজ তা প্রমাণ করে।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ

জেনারেল মঞ্জুরকে যেভাবে গুলিতে হত্যা করা হয়

ম্যালকম এক্স থেকে মামদানি

জিয়া হত্যা ছিল গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল

৭ নভেম্বর বনাম হালের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি

মোদির ভারতে অর্থ ও পেশিশক্তির গণতন্ত্র

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার : ন্যায় ফিরে এসেছে

১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়, তবু কেন এত যানজট

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কত দূরে বাংলাদেশ

ভারত-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা উচিত

ঐকমত্যের দলিল নিয়েই ঐকমত্যের ঘাটতি!