হোম > মতামত

নয়া বন্দোবস্তে ওসমান হাদির জবানবন্দি

ড. মোজাফফর হোসেন

শরিফ ওসমান হাদি (ফাইল ছবি)

নজিরবিহীন মানুষ সমবেত হয়েছিল শরীফ ওসমান হাদির জানাজায়। জানাজা শেষে সমবেত জনতা দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে, দিল্লি নয় ঢাকা; গোলামি নয় আজাদি; ক্ষমতা নয় জনতা; আপস নয় সংগ্রাম; মুজিববাদ মুর্দাবাদ; ইনকিলাব জিন্দাবাদ। এই স্লোগানগুলো অসংখ্যবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে ওসমান হাদির কণ্ঠ থেকে।

জানাজার সালাতে সমাগত মানুষের অথই জনসমুদ্রে একসঙ্গে এই বজ্র-উচ্চারণ এর অগে এই ভূখণ্ডে কেউ দেখেনি। নিঃসন্দেহে সমবেত এই উচ্চারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি সংস্কারের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হাদির দেখানো পথে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে। ওসমান হাদি নিজেই ছিলেন সেই সংস্কারের সম্মুখযোদ্ধা; স্বপ্ন বাস্তবায়নের সিপাহসালা।

দুই

প্রশ্ন হলোÑওসমান হাদির জানাজায় এত মানুষ সমবেত হলো কেন? কী ছিল ওসমান হাদির ভেতরে? বড় একটি রাজনৈতিক দলের ব্যঙ্গোক্তিতে ওসমান হাদি ‘বাচ্চা মানুষ’। এই বাচ্চা মানুষরা কীভাবে বাংলাদেশ নাড়িয়ে দিল? কোন যোগ্যতার বলে দেশকে কাঁদিয়ে গেল? এই কোন-এর উত্তর পবিত্র কোরআনে রয়েছে। কোরআন থেকে কোড করছি, ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।’ (সুরা আন নসর, আয়াত ১-২) জুলাইয়ে বিপ্লব ছিল বিজয়ের। অনেকেই বলতে পারেন, ওসমান হাদির জানাজার সালাতে অংশগ্রহণ করার অর্থ কি আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করা? আসুন দেখি কোরআন কী বলেÑকোরআন বলছেÑ‘ইন্নাদদিনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম।’ অর্থ নিশ্চয় আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। (সুরা আল-ইমরান, আয়াত ১৯)

এবার দেখি ইসলাম জিনিসটা কী। কোরআন বলছেÑ‘আর তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছো না? অথচ অসহায় দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা বলছেÑহে আমাদের রব, আমাদের বের করুন এই জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা জালিম এবং আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নির্ধারণ করুন আর একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭৫) এ আয়াতের প্রেক্ষাপট মক্কা হলেও বাংলাদেশও সে অবস্থা বিরাজমান। এ আয়াতের পারিপার্শ্বিকতা হলোÑসমাজ থেকে নিপীড়ককে উৎখাত করে নিপীড়িত মানুষকে উদ্ধার করার কাজে নিজেকে শামিল করার নামও ইসলাম। ওসমান হাদি সেই নিপীড়কদের দুশমন; জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ওসমান হাদি বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের সংসদে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে কি নাÑসে প্রসঙ্গ ভিন্ন; তবে যদি নিরঙ্কুশ মানবাধিকার কিংবা ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ইসলামের ৯০ ভাগই প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। ওসমান হাদি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কাজে সংগ্রাম করেছেন এবং সেই সংগ্রামের প্রতি সমাগত মানুষেরও ন্যূনতম মৌন সমর্থন না থাকলে এত মানুষ জানাজায় সমবেত হতে পারতেন না। কাজেই সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথটাই হচ্ছে দ্বীনের পথ বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আর একটি রাস্তা। এই বিশ্বাস নিয়েই মানুষ ওসমান হাদির জানাজায় দলে দলে এসেছেন। রয়েছেন তার মনস্তত্ত্বের সঙ্গেও। এই মনস্তত্ত্বেই ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ সামনে অগ্রসর হচ্ছে।

তিন

ওসমনা হাদি কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করেছেন। ব্রিটিশ আধিপত্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে পথ নজরুল তৈরি করেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে ওসমান হাদি সেই পথ ধরেই হেঁটেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও শোষণ সমূলে উৎপাটন করার লক্ষ্যে ওসমান হাদির জবান খুব স্পষ্ট। তিনি বাংলাদেশকেন্দ্রিক ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চেয়েছেন।

ওসমান হাদি বলেছেন, ‘আমাদের ইচ্ছা ছিল আমরা একটা রোল মডেল তৈরি করতে চাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে। মানে যে ঐতিহাসিক জুলাই হলো, এটাকে কেন্দ্র করে নতুন করে কিছু শুরু করা; যেটি আগে হয়নি; যেটাকে মানুষ পছন্দ করে। আমরা খুব সাহস নিয়ে শুরু করলাম। নিঃসঙ্গ লড়াই ছিল; কিন্তু আলহামদুলিল্লাহÑনিঃসঙ্গ লড়াই এখন এত, আল্লাহ এর সঙ্গে এত মানুষ জোগাড় করে দিয়েছেন।’ ওসমান হাদির সংগ্রামের পথটা মসৃণ ছিল না। তাকে চলতে হয়েছে ভারতীয় হেজিমনির স্রোতোধারার বিপরীতে। আওয়ামী লীগ ছাড়াও বাংলাদেশে রাজনীতি করা আরো অনেক রাজনৈতিক দল ওসমান হাদির এই পথে চলাকে পছন্দ করতে পারেনি। কিন্তু ওসমান হাদি থেমে থাকেননি।

চার

ওসমান হাদি বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতির একটা সংস্কার চেয়েছেন। এখানে নির্বাচনে শক্তি দেখিয়ে প্রচারের মাঠ দখলে রাখতে চান ভোটপ্রার্থীরা। টাকার বিনিময়ে ভোট কেনেন। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে ফেলেন মাঠ-ঘাট। মানুষ ও যানবাহন চলাচলের রাস্তাঘাটে দলীয় নেতাকর্মীরা সমাবেশ ডাকেন। সেখানে চলে অন্তঃসারশূন্য বক্তৃতা। উচ্চ ভলিউমে মাইক দিয়ে জন-অশান্তিকে বাড়িয়ে তোলেন সম্ভাব্য সাংসদদের চেলারা। আর এটার নাম দেওয়া হয়েছে নির্বাচনি আমেজ। এই বিরক্তিকর উৎপাতকে কেউ কেউ উৎসব নামে ডাকেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের এই যে পদ্ধতি, যুগের পর যুগ চলে আসছে, তার একটা সংস্কার দরকার। এই সংস্কার এমনি এমনি হবে না। এর জন্য একটা লড়াই দরকার। সে জন্য ওসমান হাদি নিজে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কীভাবে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা করতে হয়; ভোট সংগ্রহ করতে হয়। হাদি বলেছিলেন, নির্বাচনে জিততেই হবে এমন মানসিকতা তিনি লালন করেন না। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণটা যেন মার্জিত হয়, তার জন্যই তার সংগ্রাম। তিনি বলেনÑ‘এবারের নির্বাচনটা আমাদের লড়াইয়ের একটা অংশ।’

পাঁচ

বাংলাদেশপন্থি মানুষ, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান দীর্ঘদিন কালচারাললি ভারতীয় হেজিমনির শিকার হয়েছেন। ফলে বাঙালি মুসলমান যুবকদের যে মানসপট তৈরি হয়েছে, সেটি ভেঙে নতুন করে গড়তে না পারলে আখেরে ভারতের পরমাত্মীয় আওয়ামী লীগেরই আধিপত্য অটুট থাকবে। এই বাস্তবতা আঁচ করতে পেরে ওসমান হাদি বলেছেনÑ‘আমরা বলেছি, বাংলাদেশে যতক্ষণ না পর্যন্ত একটা বাংলাদেশপন্থি সাংস্কৃতিক বিপ্লব হবে, ততদিন আমাদের মুক্তি হবে না। এই যে সবাই বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, আমি এটা বিশ্বাস করি না। এখন পর্যন্তু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় কালচারালি; মানে রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গা থেকে হয়তো এর ওপরের স্তরটা নেই, কিন্তু যে ন্যারটিভ, যে এস্টাবলিশমেন্ট, যে ভাবনা, যে চিন্তাকাঠামোÑএর পুরোটাই আওয়ামী লীগের তৈরি রাজনীতির ওপরে দেশ চলছে। ধরেন এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশি যত দল আছেÑবিএনপি বলেন, জামায়াতে ইসলামী বলেন, তারা কিন্তু শুধু আগের আলোচনাগুলোর ওপরে রি-অ্যাকশন দিচ্ছে। আমরা কি নতুন করে কোনো কালচারাল এস্টবলিশমেন্ট বা চিন্তা-মনস্তত্ত্ব তৈরি করতে পারছি?

আওয়ামী লীগের ১০০টা লেয়ার ছিল বেনামে, এ সাংস্কৃতিক হেজিমনি তৈরি করার জন্য, যে তার মনস্তত্ত্ব তৈরি করে দেবে। যে ছেলেটা প্রচুর অ্যান্টিআওয়ামী লীগ হবে, সেই ছেলেটাও দিন শেষে যে পলিটিক্যাল অ্যান্ড কালচারাল ইনপুটটা দেবে, সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘরেই যাবে। হাদির এই বক্তব্য পরিষ্কার। সংগ্রামটা সময় নিয়েই করে যেতে হতে পারে। এ জন্য হাদি পলিটিক্যাল অ্যান্ড কালচারাললি বাংলাদেশপন্থি ন্যারেটিভ তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এই লড়ায়ে শক্তি প্রয়োগের ব্যাপার নেই। জয়ী হতে হলে ইন্টেলেকচুয়ালি কালচারাল কনটেস্টটা চালাতে হবে।

ছয়

মৃত্যু নিয়ে ওসমান হাদির দৃষ্টিভঙ্গি কোরআনিক। মৃত্যু হচ্ছে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের সেতু। কবি আল মাহমুদ মৃত্যুকে ঈদের মতো আনন্দের মনে করেছেন। ‘স্মৃতির মেঘলা ভোরে’ কবিতায় আল মাহমুদ বলেনÑ‘কোনো এক ভোরবেলা রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ; অপ্রস্তুত এলোমেলো এই গৃহের আলো-অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেব এ আমার ঈদ।’ কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। আর ওসমান হাদি মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মৃত্যুকে মহিমান্বিত করতে হয়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ভেতর থেকে যে মৃত্যু, সেই মৃত্যু শ্রেষ্ঠ মৃত্যু। হাদি বলতেন, ‘রাজনীতিবিদদের মৃত্যু বাসায় হতে পারে না, এটা কোনো ভালো মৃত্যু না; যিনি রাজনীতি করেন, যিনি সংগ্রামী তার মৃত্যুটা হবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজপথে।’ সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে মৃত্যুভয় থাকলে সংগ্রামে সফল হওয়া যায় না। কী আশ্চর্য! ওসমান হাদির বক্তব্য ও মৃত্যুর মধ্যে দৃষ্টান্তহীন মেলবন্ধন লক্ষ করা গেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাজনীতিতে অগ্রজরা তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে চান না। অসহিষ্ণু ভঙ্গি ও বৈরীভাবাপন্নে হাদিকে বলা হয়েছিল, তোমরা সবকিছু ভেঙে দিচ্ছো! জবাবে হাদি বলেছিলেন, ইয়েস আমরা সবকিছু ভাঙতে পেরেছি। এই বলাটা ছিল হাদির জন্য মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে বলা। হাদি বলতেন, বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে গিয়ে কোনো বিপ্লবী হত্যার শিকার হলে তার বিচার হতে হবে। বিচার না হলে নতুন বিপ্লবী জন্মাবে না। ওসমান হাদিকে হত্যাকারী ও তার মাস্টারমাইন্ডকে বের করে বিচার ত্বরান্বিত করা জরুরি।

লেখক : শিক্ষক, গবেষক, সহকারী অধ্যাপক

হাকিমপুর মহিলা কলেজ, দিনাজপুর

যেভাবে ভারতকে বদলে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা

নির্বাচন হতে যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ

একজন সেলজুক বায়রাকতার ও আমাদের মেধাবী তরুণরা

নয়া জমানার মুয়াজ্জিন ওসমান হাদি

আরেক জিয়া দেখতে চায় মানুষ

বাংলাদেশের গোয়েন্দা ব্যবস্থা : কাঠামোগত সংকট ও করণীয়

ওসমান হাদি : সংস্কৃতি, ক্ষমতা এবং গণতন্ত্রের সংগ্রাম

অধীনতাবিরোধী নতুন শক্তির উত্থান : লড়াই ও বিভাজন

বাংলাদেশের গণতন্ত্র : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে?