হোম > মতামত

দেশরক্ষায় বিজিবি

লে. কর্নেল এএসএম জাকারিয়া, পিবিজিএম, পিএসসি

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ, যার ভৌগোলিক অবস্থান ভারত ও মিয়ানমারের পাশে এবং দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর, যা বিশ্বের মানচিত্রে একটি অন্যতম নাম। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে। এ দেশের আয়তন প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার, যার মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১৭ কোটি (২০২৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী) এবং সাক্ষরতার হার আনুমানিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া এ দেশটি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই দেশটিতে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন বা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যে ভরা একটি বদ্বীপ আকৃতির দেশ। অপার সম্ভাবনাময় এই দেশটি পার্শ্ববর্তী দুটি দেশের সঙ্গে জল ও স্থলসীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। প্রতিবেশী দুটি দেশের (ভারত ও মিয়ানমার) সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত সর্বমোট ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থলসীমান্ত। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা নিয়ে গঠিত এই সুবিশাল সীমান্ত এলাকায় অবৈধ সীমান্ত পারাপার, মানবপাচার, চোরাচালান, গবাদি পশু পাচার, ভুলবশত সীমানা অতিক্রমসহ নানা ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত এই বাহিনী বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিনিয়ত গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পরিবর্তিত ভূমিরূপ ও ভৌগোলিক পরিবেশে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের স্থলসীমানাসহ খুলনা ও চট্টগ্রামের স্থল ও জলসীমানায় বিজিবি দেশের সীমান্তে সগৌরবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখা, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও সুন্দরবনের রায়মঙ্গল নদী এবং বয়েসিং খালের বনসম্পদ লুণ্ঠনসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে ভাসমান বিওপি ও সব সীমান্ত থেকে ২৪ ঘণ্টা দিনরাত প্রহরার মাধ্যমে দেশের সীমান্ত রক্ষায় বিজিবির অবদান বহুমাত্রিক ও সময়োপযোগী।

বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হার বেশি হওয়ার কারণে প্রতি বর্গকিলোমিটারে আনুমানিক ১ হাজার ৩০১ জন (২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী) মানুষ বসবাস করে, যা বাংলাদেশকে একটি জনবহুল দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে অষ্টম স্থানে দাঁড় করিয়েছে। জনবহুল এই দেশটির সীমান্তবর্তী কতিপয় অপরাধী চক্র আন্তঃরাষ্ট্রীয় সীমান্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিজিবির প্রতিটি সদস্য বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিরলসভাবে সার্বক্ষণিক প্রহরার মাধ্যমে সব বাধাকে উপেক্ষা করে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বন্ধ, সীমান্ত এলাকার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মাদক ও চোরাচালান দমনসহ স্থানীয় জনসাধারণকে নিরাপদে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বিজিবির সুসজ্জিত কমান্ড চ্যানেল কর্তৃক প্রদত্ত সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে বিজিবির প্রতিটি সদস্যকে সুশৃঙ্খল রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বিজিবির নিজস্ব গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে সীমান্ত-সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহপূর্বক অপারেশনাল কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করে আসছে। বিজিবি সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালনে যেমন দক্ষ, তেমনি তাদের কার্যক্রম মানবিক ও নিয়মতান্ত্রিক, যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। তাদের পেশাদারত্ব কেবল বাহিনীর গঠন বা সরঞ্জামে নয়, বরং মনোভাব, নীতি ও আচরণেও প্রতিফলিত হয়।

নিয়মিত টহল পরিচালনার মাধ্যমে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ বিজিবির প্রতিটি সদস্য সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এছাড়া এ বাহিনীর সদস্যরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান ও মাদক প্রতিরোধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিজিবির এই কঠোর পরিশ্রমের ফলে চোরাচালান প্রতিরোধের কারণে দেশ একদিকে মূল্যবান সম্পদ, যেমন মানবসম্পদ ও জ্বালানি তেলের মতো মূল্যবান বস্তু পাচার রোধে সক্ষম হচ্ছে, তেমনি অবৈধ দ্রব্যাদি প্রবেশ প্রতিরোধের ফলে দেশ উন্নত হচ্ছে। বিজিবি কর্তৃক আটককৃত চোরাচালানের মালামাল নিয়মানুযায়ী স্থানীয় কাস্টমসে জমাকরণ এবং পরে কাস্টমস কর্তৃক নিলামের মাধ্যমে মালামাল বিক্রয় করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হচ্ছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে বিজিবি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের যুবসমাজ মাকদাসক্তির করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাচ্ছে। অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবির অধিক সতর্কতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপের কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নাশকতা ও অপরাধমূলক কার্যক্রম ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে, যা আইন-শৃঙ্খলা অবনতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করছে। এছাড়া নারী ও শিশু পাচার রোধে বিজিবির তৎপরতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় এবং সক্রিয় টহল তৎপরতার কারণে রোহিঙ্গাসহ অবৈধ অনুপ্রবেশ হ্রাস পেয়েছে।

দুর্গম ও বিপদসংকুল পরিবেশে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি নিয়মিত টহলের মাধ্যমে ভৌগোলিক আয়তনের সীমানার সুরক্ষা ও নিশ্চয়তা প্রদানে বিজিবির পরিষেবা প্রতিনিয়ত চলমান রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল ও দুর্গম সীমান্ত এলাকাগুলোয় বিজিবি তাদের দায়িত্ব কঠোরভাবে ও পেশাদারত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে এসব স্থানে যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় বিজিবি সদস্যরা পায়ে হেঁটে প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, যেটা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত অধিকাংশ নাগরিক দরিদ্র ও বেকার হওয়ায় জীবিকা নির্বাহের তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অল্প শ্রমে অধিক লাভের আশায় কতিপয় জনসাধারণ চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জনসাধারণদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিজিবি দ্ররিদ্রদের মাঝে আর্থিক সহায়তাসহ সেলাই মেশিন, গবাদি পশু, বসতঘর ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। এর ফলে স্বল্প আয়ের পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে নারীরা স্বনির্ভর হয়ে উপার্জনের সুযোগ পেলে সীমান্তে চোরাচালান ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

বিজিবি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যায় আটকে পড়া পানিবন্দি মানুষের পাশে তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন রেখেও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে এবং ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে। সাধারণত বন্যাপ্লাবিত এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন বিজিবি সদস্যরা। বিশেষ করে শিশু, নারী ও বয়স্কদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্ধার করা হচ্ছে। এছাড়া মেডিকেল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সহায়তা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বন্যাদুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খাবার স্যালাইন, শিশুখাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়। বন্যা ও বৃষ্টির পানি এবং পরিবেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য স্থানীয় জনসাধারণদের নিয়মিত প্রেষণা প্রদানের মাধ্যমে সচেতন করা হয়। এছাড়া বন্যাসহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিজিবি সদাসর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় এই মানবিক ভূমিকায় বিজিবি দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে।

মানবিক কর্মকাণ্ডে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয়। বিজিবি শুধু সীমান্ত রক্ষা করে না, বরং দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ, সংকট ও মানবিক প্রয়োজনে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিধস বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিজিবি ত্রাণ বিতরণ, উদ্ধারকাজ এবং পুনর্বাসনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি বিতরণ করে থাকে। এছাড়া মাদক, নারী ও শিশু পাচার এবং মানবপাচার প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক সভা-সেমিনারের আয়োজন করে জনসাধারণদের প্রেষণা প্রদান করে। বিজিবি প্রতিবছর শীত মৌসুমে শীতার্ত, দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মাঝে কম্বল ও শীতবস্ত্র বিতরণ করে। সীমান্ত এলাকার জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিজিবি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

সর্বোপরি বিজিবি শুধু একটি সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী নয়, এই বাহিনী দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও পেশাদার বাহিনী যারা দেশের সার্বভৌমত্ব, জনগণের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় নিরবচ্ছিন্ন অবদান রেখে চলেছে। বিজিবি দেশপ্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও নির্ভরতা নিশ্চিত করেছে।

স্বৈরশাসকদের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন

যুদ্ধের নীরব অস্ত্র যৌন নিপীড়ন

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

ভূমিকম্পের মাত্রা যদি আরেকটু বেশি হতো!

পাহাড়ে নতুন ষড়যন্ত্র

বিনোদনের বিপ্লব ও জেন-জি সংস্কৃতি

বামপন্থা ও স্বৈরাচার

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের দ্বিধা