একসময়ের প্রথিতযশা চিকিৎসক প্রফেসর নুরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যার সংক্ষিপ্ত নাম ছিল ‘আধূনিক’, মানে ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’। ঢাকার বাইরে এক জেলা শহরে দরিদ্রদের কল্যাণে ‘আমরা কিছু করি’ (আকিক) নামে একটি এনজিও দেখেছিলাম ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি।
সে সময় সচেতন মানুষের একটি অংশ পেশাদার কাজে যুক্ত হতো সমাজসেবার ব্রত নিয়ে বা নিজেকে বিলিয়ে দিতে। আমাদের প্রজন্মের অনেকের সাংবাদিকতায় আসাও কিছুটা আদর্শিক চিন্তা থেকেই। তখন ভাবতে পারিনি দুই দশকের মধ্যেই দেখতে হবে পেশাদারিত্বের আত্মহনন এবং সেই সঙ্গে জাতীয় অধঃপতন।
ভালো কিছু করতে সক্রিয় না থেকে বরং সমাজে ‘আমরা প্রতিবাদ করি না’ (আপস করি) কিংবা সাংবাদিকতার নামে ‘আমরা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করি না’ (দালালি করি) গোছের প্রবণতাই যেন ‘নিউ নরমাল’ (স্বাভাবিক) হয়ে পড়ে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সময়কালে। এটা ছিল গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা, ফ্যাসিবাদী শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের যাত্রাপালা, যেখানে বলির পাঁঠা ছিল ভিন্নমতাবলম্বী, প্রতিবাদকারী, সত্য বলতে সচেষ্ট সাংবাদিক এবং চূড়ান্তভাবে ভোট দিতে আগ্রহী বাংলাদেশের মানুষ।
এই তো ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের নামে আমরা দেখতাম সার্কাস। রিপোর্টার এবং বিশেষ করে সম্পাদক নামধারী একদল ভাঁড় তার বন্দনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন, যে দৃশ্য দেড় দশকে মঞ্চস্থ হয়েছে বারবার।
যেন ব্যাংক খাতে কোনো ঋণ জালিয়াতি বা শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেনি, বিদেশি ঋণে দেশ ডুবে যায়নি, গুম-খুন, বিচারবহির্ভুত বা বিচারিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি, মাদক চোরাচালান বন্ধ হয়ে গেছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিতান্তই গুজব, ছোট-বড় কোনো প্রকল্প থেকেই জণগণের অর্থ লুট হয়নি, সব বিরোধী দলকে জামাই আদর করা হয়েছে এবং দেশে প্রশ্নাতীত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে!
সুতরাং অযথা কৈফিয়ত চেয়ে কঠিন প্রশ্ন করে, তাদের নিজেদের ভাষায়, তাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বিব্রত করার কী প্রয়োজন! আর এ আনুগত্যের পুরস্কার তো দিয়েই যাচ্ছিলেন ‘ম্যাজিক লেডি’, যিনি তাদের বিশ্বাসমতে জগত সংসারের তাবৎ সমস্যাই ‘ম্যানেজ’ করার ক্ষমতা রাখতেন, যার কোনো বিকল্প ছিল না দেশ পরিচালনায়।
তাহলে নিজেদের পরিচয় করিয়েই দিয়েছিলেন তারা কারাÑআর যাই হন, সাংবাদিক ছিলেন না। কারণ তারা গণতন্ত্র হত্যা এবং মানুষের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি অথবা নির্মোহভাবে সত্য তুলে ধরার পবিত্র দায়িত্ব পালন করেননি। উল্টো জাতিকে বিভক্ত করতে এবং পরদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে বয়ান তৈরিতে নিয়োজিত থেকেছেন।
তাদের কারণে স্বৈরাচারী শাসন অক্ষত রাখা এবং নিজস্ব আত্মপ্রসাদ লাভের বাইরেও হাসিনা বলার সুযোগ পেয়েছেন, বাংলাদেশে তো অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে। চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং সমাজে শত ফুল ফোটায় সমর্থন দেওয়ার যে কথা বলেছেন, সেখানে টেক্সট বইয়ে লেখা ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’-এর মিডিয়ায় ফোটে শত ধুতরার ফুল।
সেই বিষাক্ত পরিবেশে, মৌলিক অধিকার হরণকারী শাসকের অনুগত মিডিয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী এবং গণমানুষের অধিকার হরণের তথ্য এবং জনকল্যাণের ইস্যুগুলো জায়গা পাবে কীভাবে!
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনÑআপনারা যারা এখন তেলবাজ সাংবাদিকদের সমালোচনা করছেন, তারাই বা তখন কী করেছিলেন? সে কৈফিয়ত নিশ্চয়ই দেওয়া দরকার।
এই লেখক হাসিনা যুগের অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বাইরেও মিথ্যাচার ও মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে ইংরেজিতে যা লিখেছিলেন, তার কিছু বাংলা শিরোনাম এরকমÑ‘কাকুতি মিনতি করতে দ্বিধা নয়’, ‘গণতন্ত্রহীন গণমাধ্যম, গণমাধ্যমহীন গণতন্ত্র’, ‘আপনিও কি সুবিধাভোগী?’, ‘বাজে কথার ভালো মানে করার প্রয়াস’, ‘একটি কিনুন, আরেকটি ভুলে যান’, ‘মানবিক গল্পকে যেভাবে অমানবিক বানাই আমরা’, ‘প্রশ্ন করতে ভুলে যাওয়ার প্রতিবেদন’ এবং ‘স্পষ্ট কথা বলার আমরা কারা?’
বলতে পারেন তাতে কী হয়েছে, বিশেষ করে মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকায়! ফ্যাসিবাদী আমলে যারা পেশাদার সাংবাদিকতা চর্চার চেষ্টা করেছেন, তারা অন্তত নিজস্ব দায়িত্বটি পালন করেছেন এবং সেজন্য মূল্যও দিয়েছেন, চাকরি হারিয়ে, মামলা-হামলার শিকার কিংবা দেশান্তরিত হয়ে। কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দখল এবং আমার দেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাস্তবে হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা অলিগার্কি গণমাধ্যমকে কবজা করে ফেলে, বাকিটা রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলো দেখভাল করে। এক অন্যায় রাজত্বে গণতন্ত্রের পক্ষে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পরিসর একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়ে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি, এর দোসর মালিক শ্রেণি এবং হাসিনার ভাড়াটে মিডিয়া সেবাদাসদের এক নেক্সাস গণমাধ্যমের নষ্ট চরিত্র প্রদর্শন করে জনগণের সামনে।
বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করলে কিংবা তিনি আওয়ামী বালুর ট্রাকের বাধায় ভাড়া বাড়িতে আটকা পড়লে তথাকথিত মিডিয়া হাউসগুলোয় উল্লাস লক্ষ করা যায়। জঙ্গি নাটককে বিনা প্রশ্নে সত্য ঘটনা বলে প্রচার করা এবং প্রতারিত মানুষকেই অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়। সীমান্তে বিএসএফের হত্যার শিকার বাংলাদেশিকে গরু ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে এবং ভারতকে প্রদত্ত নানা সুবিধা ও ছাড় সম্পর্কে জাতীয় স্বার্থের বিপরীতেই দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের দোসর মিডিয়াকে।
জাতির বুকে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী শাসকদের মতোই তাদের দালাল মিডিয়া স্বেচ্ছাসেবকরাও হয়তো ভেবেছিলেন কেয়ামত পর্যন্ত তাদের রাজত্বের অবসান হবে না। না হলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও পালাবেন কেন?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাসিনার অনুসারী এই ‘মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা’ গণবিরোধী ও মিথ্যাচারের কারবারকে সাংবাদিকতা বলে শিখিয়েছেন একটি প্রজন্মকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ওই হতভাগারা আওয়ামী লীগের বয়ান অনুসরণ করাকেই শ্রেয় বলে মনে করছেন। যে অপশিক্ষার ছাপ মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমÑউভয় জায়গায়ই সুস্পষ্ট।
গত প্রায় দেড় বছরে ওই মিডিয়ার মৌলিক চরিত্র খুব একটা বদলায়নি, দু-চার ব্যক্তির পরিবর্তন ছাড়া। মিডিয়ার কর্ণধার অলিগার্কদের কেউ কেউ তাদের বন্ধুদের বলছেন, অমুক দল তাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। যদিও এদের বেশ কয়েকজন হাসিনা আমলের মালিকানা ও আওয়ামী লীগের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক সংস্কার, হাসিনা গংয়ের হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির বিচার এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কার্যকর ও চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ নিলেও গণমাধ্যম থেকে ফ্যাসিবাদী ভূত তাড়ানো, মিডিয়ার অর্থপূর্ণ সংস্কার এবং সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের সামগ্রিক কল্যাণে বোধগম্য কিছুই করেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
প্রমাণ হলো, আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করা মিডিয়া পতিত সরকারের দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন এবং গণতন্ত্র ও দেশবিরোধী কার্যকলাপ ও সেগুলোর দালিলিক প্রমাণসহ অনুসন্ধানী প্রতবেদন প্রকাশ এবং ক্ষুরধার বিশ্লেষণ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে, এমন ইঙ্গিতও মেলেনি। বরং নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না বলার চেষ্টাও পাঠক-দর্শক বুঝতে পারে। অথচ রাজনৈতিক, নৈতিক, আইনগত কোনো বিবেচনায়ই ফ্যাসিবাদী দলের নির্বাচন করার সুযোগ নেই, পৃথিবীর কোথাও না।
সাংবাদিকদের যে অংশটি মহান পেশার গৌরবকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন, তারা নিজেরাই ছিটকে পড়েছেন নিজস্ব কর্মের গুণে। ভোল পালটে ঘাপটি মেরে টিকে থাকার চেষ্টাও আছে কারো কারো।
এখন মিডিয়ার কর্ণধারদের অনেকে ‘কান্না’ করছেন, যাতে কেউ তাদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকট থেকে বেরোতে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। তারপরও পেশাদারিত্বের মান বাড়ানো এবং মিডিয়াশিল্পকে টেকসই রূপ দেওয়ার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
নিজেদের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার আদলে এ দেশের মিডিয়ার বড় একটি অংশ আওয়ামী লীগের দালালি করতে গিয়ে দেশ এবং গণতন্ত্রের সর্বনাশে দোসরের ভূমিকা পালন করেছে। সেই প্রায় একই মিডিয়া আগামী গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহযোগী ভূমিকা রাখবে, এমন বিশ্বাস ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।
লেখক : খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক