টকশোর ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। শুরু রেডিওতে। ছোট আলাপ। সরল কথোপকথন। ১৯২০-এর দশক। আমেরিকা। শ্রোতা মোহিত। এটাই ছিল বীজ।
টেলিভিশন এলো পরে। ১৯৫০-এর দশকেই শুরু হলো আসল খেলা। স্টিভ অ্যালেন। জনি কারসন। রাতের শো। হালকা রসিকতা। সুশৃঙ্খল আলোচনা। দর্শক মুগ্ধ। ফরম্যাটও প্রতিষ্ঠা পেল।
৬০-এর দশকে টকশো আরো ধারালো হলো। ভিয়েতনাম যুদ্ধ। নাগরিক অধিকার আন্দোলন। রাজনীতি উঠে এলো স্টুডিওতে। টিভি হয়ে উঠল বিতর্কের যুদ্ধক্ষেত্র।
৭০ থেকে ৮০Ñটকশো সমাজকে নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল। বিবিসির ‘Question Time’ আলোচনায় আগুন ধরাল। ফিল ডোনাহিউ আমেরিকায় নতুন ট্রেন্ড তৈরি করলেন। মানুষ টকশো দেখত তথ্যের জন্য। বোঝার জন্য।
৯০-এর দশকে দৃশ্য পাল্টে গেল। কেবল টিভি বাড়ল। টকশো হলো দুই ধারায় বিভক্ত। একদিকে গম্ভীর রাজনৈতিক বিতর্ক, অন্যদিকে সস্তা উত্তেজনার বাজার। চিৎকার। কান্নাকাটি। মেলোড্রামা। এই দ্বিতীয় ধারাই দ্রুত ছড়াল।
বাংলাদেশে টকশোর উত্থান ২০০০-এর দশকের শুরু। চ্যানেল বাড়ল। অ্যাংকর বাড়ল। দর্শকও অভ্যস্ত হলো। ২০০৭-এর রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় টকশো পরিণত হলো কেন্দ্রীয় মঞ্চে। রাতের নিয়মিত আড্ডা নয়Ñএকটা জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্র।
২০১০-এর পর ছবিটা আরো পাল্টাল। টকশো হলো প্রতিদিনের রুটিন। বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, দলীয় প্রতিনিধিÑসবাই হাজির। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এক নতুন চাপ জন্ম নিল। ভাইরাল হতে হবে। ঝগড়া লাগাতে হবে। চিৎকারে স্টুডিও গরম রাখতে হবে।
এই তো টকশোর ইতিহাস। কথার মঞ্চ থেকে আমরা এসেছি উত্তেজনার কারখানায়। টকশোর বয়স বাড়ে। ফরম্যাট বদলায়। কিন্তু প্রশ্ন একটাইÑ আলোচনা কি এখনো বেঁচে আছে? নাকি আমরা শুধু শব্দ শুনছি?
আমরা জানি, বাংলাদেশের মূলধারা মিডিয়া আজ এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সংবাদ ঘরগুলোয় তদন্ত নেই, অনুসন্ধান নেই, সত্যের সাধনা নেই। আছে কেবল আওয়াজ। সেই আওয়াজের নতুন মঞ্চÑটেলিভিশনের টকশো। কথা হওয়ার কথা ছিল যুক্তিতে। কিন্তু যা হচ্ছে তা শুধু ঝগড়া এবং তা-ও বস্তির ঝগড়ার মতো। লাইভে চলছে অশ্লীল গালাগালি।
স্টুডিওতে ক্যামেরা, লাইট, ব্যাকড্রপÑসব আছে। নেই শুধু সাংবাদিকতা।
অনেক অ্যাংকরের পড়াশোনা নেই। সাংবাদিকও নন। তবু তারা ‘শো’ চালান। আর শো বলতে বোঝেন চিৎকার, খোঁচা, অপমান, মরিয়া হয়ে ভাইরাল হওয়া। স্টুডিওর ভেতরেই তৈরি হচ্ছে ইউটিউব থাম্বনেইল-‘দারুণ ঝগড়া’, ‘লাইভে গালি’, ‘অমুককে একহাত নিল তমুক’।
টেলিভিশনের পর্দা আজ তথ্যের প্ল্যাটফর্ম নয়। হয়ে গেছে বিনোদনজনিত উত্তেজনার বাজার। দর্শকরাও দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রাজনীতি বুঝতে নয়, মারামারি দেখতে। যুক্তি শুনতে নয়, ‘ধোলাই’ দেখতে। শো’র সঞ্চালক যেন রেফারি ননÑসে নিজেই ঝগড়ার সক্রিয় অংশ।
এ দেশে টকশোর একটা সময় ছিল। মানুষ দেখত বিষয় বোঝার জন্য। বিশেষজ্ঞরা আসতেন বিশ্লেষণ দিতে। এখন বিশেষজ্ঞের চাহিদা বেশি নয়। চাহিদা বেশি পক্ষ-বিপক্ষের গলাবাজদের। সাংবাদিকতা নেই। শুধু প্রচার আছে। প্রদর্শনী আছে। আছে উত্তেজনার ব্যবসা।
এই অবস্থা কীভাবে তৈরি হলো?
প্রথমত, আমাদের অনেক চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা সাংবাদিকতার মান দেখেন না। দেখেন কন্টেন্ট কত ‘দর্শক টানতে’ পারে।
দ্বিতীয়ত, টকশোর দায়িত্বে এমন মানুষদের বসানো হয় যাদের রাজনৈতিক পক্ষপাত স্পষ্ট। দলবাজ। অসাংবাদিক। ফলে টেবিলের চারদিকে আসল আলোচনা নয়Ñদলগত লড়াই।
তৃতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক-শেয়ার-ভিউয়ের বাজার পুরো মিডিয়াকে গ্রাস করেছে। ‘ভাইরাল’ আজ পেশাগত মানদণ্ড হয়ে গেছে।
টকশোর নেতিবাচক প্রভাব এখন রাজনীতিকে সরাসরি আঘাত করছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিলÑরাজনীতি বদলাবে। ভাষা বদলাবে। আচরণ বদলাবে। কিন্তু টেলিভিশনের টকশোগুলো সেই সম্ভাবনাকে উল্টো দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
স্টুডিওতে যে ঝগড়া, অপমান, বিদ্বেষ ছড়ানো হয় তা সরাসরি নেমে যাচ্ছে রাজনৈতিক মাঠে। রাজনৈতিক কর্মীরা নিজেদের কথাবার্তা সাজাচ্ছে টিভির কথার মতো করে।
চিৎকার, হুমকি, তাচ্ছিল্যÑএসব এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদি রূপ হয়ে উঠছে। ফলে প্রতিহিংসা বেড়েছে। উত্তেজনা বেড়েছে। সহিংস ঘটনাও ঘটছে। রাজনীতি শান্ত হচ্ছে না; বরং আরো কলুষিত হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া তো এই আগুনে ঘি ঢালছে। টকশো’র ক্লিপ ভাইরাল হয়। প্রত্যেক পক্ষ তার পক্ষের আক্রমণাত্মক অংশ শেয়ার করে। কমেন্ট সেকশনে শুরু হয় আরেক দফা যুদ্ধ। গালিগালাজ স্বাভাবিক। অপমান স্বাভাবিক। রাজনৈতিক কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় পরস্পরকে মানুষ হিসেবেও মানতে চাইছে না।
টকশো আজ তথ্যের জায়গা নয় উত্তেজনার উৎস। এই উত্তেজনা রাজনীতিকে বিপজ্জনকভাবে প্রভাবিত করছে। যে পরিবর্তন মানুষ আশা করেছিল, সেই পরিবর্তনকে আছড়ে ফেলে দিচ্ছে পর্দার ঝগড়া।
এখন প্রশ্নÑটকশো কি রাজনীতিকে সচেতন করবে, নাকি রাজনীতি টকশোর আগুনে আরো পুড়বে?
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এভাবে চললে টকশোয় আর গণতান্ত্রিক আলাপচারিতা হবে না। এ হবে শুধু উত্তেজনা তৈরির যন্ত্র। তাদের ভাষায় ‘যে শো দর্শককে জ্ঞানী করে না, তথ্য দেয়, দর্শকদের সমৃদ্ধ করে না, সে শো গণমাধ্যম নয়Ñএটা শুধু প্রদর্শনী।’ আরো এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ টকশো এখন ‘ক্রাইসিস-থিয়েটার’। উদ্দেশ্য সমস্যা সমাধান নয়; সমস্যা বিক্রি করা।’
তাদের মতে, বিশ্বাসযোগ্য টকশোর তিনটি শর্ত ১. প্রস্তুত অ্যাংকর, ২. প্রাজ্ঞ অতিথি ও ৩. সুস্থ বিতর্কের পরিবেশ। এই তিনটির কোনোটিই আমরা নিয়মিত পাই না। ফলে শো হয়, কিন্তু আলোচনা হয় না।
বাংলাদেশের টকশো সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে কিছু কঠিন সত্য স্বীকার করতে হবেÑ
* ভাইরাল সংস্কৃতি সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করছে
* চিৎকার কখনো বিশ্লেষণ নয়
* অ্যাংকরের প্রস্তুতি শোর মান নির্ধারণ করে
* দর্শককে বিনোদিত করা নয়Ñসচেতন করাই টেলিভিশনের দায়িত্ব
টকশো কখনো বিনোদনমূলক হতে পারে, কিন্তু সেটি তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে না হলে তা কেবল কর্কশ শব্দে পরিণত হয়। আজ আমাদের ঠিক সেটাই শুনতে হচ্ছেÑশব্দ।
আশার কথাÑমানুষ এখন টকশোতে ক্লান্ত। তারা মানসম্মত আলাপ চায়। এটাই সুযোগ। চ্যানেলগুলো চাইলে টকশোগুলোকে আবার জ্ঞান ও তথ্যভিত্তিক করতে পারে। দরকার শুধু পেশাদারিত্ব, প্রস্তুতি এবং সৎ মনোভাব। যেদিন এই তিনটি ফিরে আসবে, সেদিন টকশো আবার সাংবাদিকতার আসনটি ফিরে পাবে। আর সেই পথচলায় উপস্থাপকদের ভূমিকাÑঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরদার ফরিদ আহমদ : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন