হোম > মতামত

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

কামরুননেসা হাসান

অনেক পথ চলেছি। ক্যামেরার লাল আলো, স্টুডিওর উত্তাপ, রাতভর পরিকল্পনা আর জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া একের পর এক শিল্প—সব মিলিয়ে বিটিভির করিডোর আজও আমার ভেতর অনুরণিত হয়। কিন্তু কিছু স্মৃতি আছে, যেগুলো মনে পড়লে হৃদয়ের ভেতর আলো হেসে ওঠে।

রুনা লায়লা—সেই আলোর অন্যতম উৎস।

বাংলাদেশের সংগীতজগতে বহু তারকা উঠেছে। কিন্তু রুনা লায়লা ছিলেন এক নক্ষত্র—যার আলো শুধু গানেই নয়, সংস্কৃতির প্রতিটি সুরে, প্রতিটি শিরায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি—কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে, তিনি কণ্ঠ নয়, বিস্ময় নিয়ে জন্মেছেন।

উচ্চাঙ্গ সংগীত—খেয়াল, ঠুমরি, গজল, রাগপ্রধান বাংলা গান—যত শাখাই ধরুন না কেন, তাঁর কণ্ঠে সবকিছুই যেন অন্য এক অলৌকিক ভাষা পায়।

চ্যানেল আইয়ের জন্য সেই ঐতিহাসিক যাত্রাটি মনে পড়ে। একদিন চ্যানেল আইয়ের কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর আমাকে বললেন—

Ñআপা, রুনা লায়লার কিছু গান ভিডিও করে দেন।’

আমি অবাক।

বললাম—‘রুনা লায়লার সঙ্গে তো আমার তেমন আলাপ নেই। সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে রেডিও থেকেই সম্পর্ক… আর রুনা লায়লা? শুনেছি তিনি দাম্ভিক, রাগী, অহংকারী পর্যন্ত!’

সাগর হেসে বললেন—“আপনার অভিধানে ‘না’ বলে কোনো কথা নেই। আপনিই পারবেন।”

এরপর আর কিছু বলার থাকে না।

কিন্তু এরপর শুরু হলো আমার ঘুমহীন রাত।

কীভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করব?

অবশেষে ভরসা নিলাম একজনের—প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী।

যিনি তখন চলচ্চিত্র জগতের শীর্ষ সুরকার আর বেশির ভাগ ছবির গানই গাইতেন রুনা লায়লা।

আলী ভাই বললেন—‘আগামীকাল সন্ধ্যায় শ্রুতি স্টুডিওতে তাঁর রেকর্ডিং আছে। আমি বলে রেখেছি। আপনি আসেন।’

দ্বিধা, উত্তেজনা, ভয়—সব মিলিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় স্টুডিওতে গেলাম।

আলী ভাই বললেন—‘পাশের রুমে শিল্পী আপনার অপেক্ষায়। যান।’

আমি দরজা খুলতেই ভুবনমোহিনী হাসি, আন্তর্জাতিক এক সংগীত-মহিরুহ।

সালাম বিনিময় হলো। আমি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা বললাম।

তিনি শুধুই জানতে চাইলেন—‘ক্যামেরাম্যান কে?’

বললাম—‘খালিদ মাহমুদ মিঠু।’

হালকা হাসি দিয়ে বললেন—‘মিঠু ভালো ছেলে। তাহলে শুরু করি।’

শিডিউল সব ঠিক হলো মুহূর্তেই।

তিনি হাসিমুখে বললেন—‘আপনার কাজের ওপর আমার ভরসা আছে।’

আমি সরাসরি ছুটে গেলাম সাগরের কাছে।

সাগর দাঁড়িয়ে ছিলেন—‘আপা, আপনি পারবেনই।’

লোকেশন শুটিং স্মৃতি : আমার ধারণাগুলো মিথ্যে হয়ে গেল। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একাধিক লোকেশনে শুটিং হলো।

আমি অবাক—যাকে মানুষ ‘দাম্ভিক’ বলে, তাঁর মধ্যে এর একটিও পাইনি।

বরং—অবিশ্বাস্য সহযোগিতা।

অপূর্ব পেশাদারিত্ব।

শ্রদ্ধা, সৌন্দর্য আর শৃঙ্খলা।

পরবর্তীকালে আমি তাঁর জন্য বহু অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেছি।

আর প্রতিবারই মনে হয়েছে—

যার জন্মই সংগীতের জন্য—তাকে একটুও বদলানো যায় না।

শৈশবের রুনা : যিনি ছিলেন সুরের আশীর্বাদ। রুনা লায়লার শৈশব পাকিস্তানে।

নাচের প্রতি ঝোঁক বেশি ছিল।

কিন্তু এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তাঁর ভাগ্যে লেখা হয়ে যায় সংগীতের আশীর্বাদ।

পাকিস্তানে কোনো এক অনুষ্ঠানে বড় বোন দীনা লায়লা গান করবেন। হঠাৎ অসুস্থ, মঞ্চে উঠতে পারবেন না—আয়োজকরা বিপদে।

শেষ মুহূর্তে শিশু—রুনা—মঞ্চে ওঠে।

বোনের শেখানো গান অবলীলায় গেয়ে ফেলে।

সেদিনই শুরু তাঁর সুর-সাধনা। আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

এরপর—

পাকিস্তানের প্রখ্যাত শিল্পীরা পর্যন্ত ঈর্ষা করতেন তাঁর কণ্ঠের পরিবেশনা।

দেশ থেকে দেশান্তরে তাঁর গানের ঝরনাধারা।

১৯৭৪ সালে মা-বাবাসহ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন।

আর এসেই জয় করলেন—

চলচ্চিত্র, মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন।

রাগপ্রধান বাংলা গান হোক, আধুনিক, গজল বা খেয়ালÑসব জায়গায় তাঁর কণ্ঠ এক নতুন ধারার জন্ম দিল।

আরেকটি স্মৃতি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড : এক স্বর্ণালি দিন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওয়ার্ল্ড সার্ভিস উদ্বোধন। প্রধান অতিথি—তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

আমাকে বলা হলো—‘শিল্পী নির্বাচন আপনার দায়িত্ব।’

আমি সাহস করলাম অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে।

তিন নক্ষত্রকে আমন্ত্রণ জানালাম—সাবিনা ইয়াসমিন-রুনা লায়লা-শাহনাজ রহমতউল্লাহ।

বাংলার তিন পাখি।

তিন সৌরজগতের মতো জ্যোতিষ্ক।

তিনজনই আন্তর্জাতিক খ্যাতি, তিনজনই কিংবদন্তি—

তিনজনেরই সময়ের দাম আকাশছোঁয়া।

আর সাধারণত যেকোনো একজন শিল্পীই একাই অনুষ্ঠানকে পূর্ণ করে দেন।

দুজন হলে ইতিহাস হয়।

কিন্তু তিনজন একসঙ্গে—তা তো স্বপ্নেরও অতীত!

তবু আমি সাহস করলাম।

প্রথমে ফোন দিলাম সাবিনাকে।

তখন তিনি কলকাতায়, ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা…

তারপর তার কোমল কণ্ঠÑ‘মেনকা আপা, তুমি বলছো—আমি না এসে পারি?’

আমি বিমূঢ় হয়ে ফোন নামিয়ে রাখলাম।

এখনো মনে হয়, কতটা ভালোবাসা আর আস্থা হলে কেউ এমনভাবে বলে!

তারপর রুনা লায়লা—যাকে আমি সবসময়ই মনে করি বাংলা গানের অনিঃশেষ আলো।

তার সঙ্গে কথা বলতে সবসময় এক ধরনের নীরব শ্রদ্ধা কাজ করে।

আর শাহনাজ—বাংলা গানের সাদা রাজহাঁসের মতো নীরব অথচ রাজকীয় সেই কণ্ঠ—

তিনি যেন শুনেই বুঝে গেলেন অনুষ্ঠানের মহিমা।

তিনজনই রাজি।

আমি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম—এমন ঘটনা কি কখনো ঘটে? নাকি কখনো ঘটানো যায়?

তারপর শুরু হলো প্রস্তুতি।

স্টুডিওগুলো সাজানো হলো নতুন আলোয়।

মঞ্চে, ক্যামেরার সামনে—তিন কিংবদন্তি একই আকাশের নিচে দাঁড়ানো।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম নীরবে—মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের জন্ম আমি নিজের চোখে দেখছি।

যেদিন সম্প্রচার হলো—দেশ যেন থমকে দাঁড়াল।

‘এ তো শুধু অনুষ্ঠান নয়—এ তো আমাদের দেশকে নতুনভাবে দেখার জানালা।’

আজ এত বছর পরেও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আমার হৃদয়ে এক বর্ণালি আলো হয়ে জ্বলছে। আর তিনজন শিল্পীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা—আজও আগের মতোই গভীর।

কারণ তারা শুধু গান গাইলেন না—একটি জাতির সাংস্কৃতিক সম্মানকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরলেন।

আমি আমার ডায়েরির পাতায় এই স্মৃতিগুলো লিখে রাখলাম—

যেন ভুলে না যাই,

সেটাই প্রথম—বারবার শুধু সে দৃশ্য চোখে ভাসে। তিনজন একসঙ্গে বিটিভির অডিটোরিয়ামে পরিবেশন করছেন।

সেদিন স্টুডিওর বাতাস পর্যন্ত বদলে গিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ। দেশ মুগ্ধ।

এ দৃশ্য আমার জীবনে এক অকল্পনীয় ইতিহাস হয়ে আছে।

দেশাত্মবোধক গানে রুনা লায়লার জুরি মেলা ভার।

‘স্মৃতি ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে’—কবি শামসুর রাহমানের লেখা / খন্দকার নূরুল আলমের সুরÑ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’— নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা / আলাউদ্দিন আলীর সুর

‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য রাগে’— ড. মুহাম্মদ মনিরুজ্জামানের লেখা / দেবু ভট্টাচার্যের সুর

‘আমার মন পাখিটা যায় রে উড়ে’—মোহাম্মদ রফিক-উজ-জামানের লেখা / খন্দকার নূরুল আলমের সুর।

আরো অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান, যা আজও চিরকালীন।

তদানীন্তন বিটিভির উপমহাপরিচালক খালেদা ফাহমী, প্রধান ক্যামেরাম্যান সৈয়দ মাহমুদ আহমেদ—যারা ‘লক্ষ প্রাণের মূল্যে গড়েছি সোনার বাংলাদেশ’-এর মতো কালজয়ী কাজ উপহার দিয়েছেন। যে গানের শুটিং হয়েছিল সেনা-নৌ-বিমানবাহিনীর ঘাটে।

চলচ্চিত্রের তাঁর কণ্ঠ দেওয়া গানের কথা কী বলব। প্রতিটি ছবির সব গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

উপমহাদেশের সব প্রখ্যাত সুরকার এবং শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন।

রুনা লায়লা : আমার চিরস্থায়ী শ্রদ্ধার নাম। আজ ডায়েরির এই পাতায় লিখতে লিখতে মনে হয়—আমি যেন আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো আবার ছুঁয়ে দেখছি।

রুনা লায়লার প্রতি আমার শ্রদ্ধা—কথায় মাপা যায় না।

তিনি শুধু গান গাইতেন না—বাংলাদেশের আত্মাকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিতেন।

এত বড় মাপের একজন শিল্পীর সঙ্গে কাজ করা আমার জীবনের সর্বোচ্চ গৌরব।

রুনা লায়লা আমাদের অহংকার। আজকের দিনে তাঁর সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

ভোট কারচুপি রোধে প্রয়োজন সিসি ক্যামেরা

দুর্নীতির মহানগর থেকে ট্রিলিয়ন ডলারের স্বপ্নযাত্রা

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

রাজনীতিতে শেষ কথা ও রাজনীতিবিদদের সততা

হাসিনার রায় : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও আঞ্চলিক পরিণতি

সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন নয়া বন্দোবস্ত

রায় লেখা ছিল দেয়ালে দেয়ালে

হাসিনা দেশে ঢোকার ১৩তম দিনে খুন হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া

আধুনিক ঢাকার রূপকার জি এ মাদানি

ইহুদিবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মামদানির লড়াই