বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি বঙ্গোপসাগর আজ এক নীরব মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে চলেছে। গত ৫ নভেম্বর থেকে বাগেরহাটের কেবিঘাট, পিরোজপুরের পাড়ের হাট এবং পটুয়াখালীর মহিপুর ও আলীপুর দেশের প্রধান চারটি মৎস্য ল্যান্ডিং সাইট সরেজমিনে পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে কথোপকথনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা শুধু উদ্বেগজনকই নয়, বরং ভয়াবহ। ধ্বংসাত্মক আহরণ পদ্ধতির কারণে আগামী দুই দশকের মধ্যে বঙ্গোপসাগর জীবশূন্য হয়ে পড়ার প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে।
গবেষণার অংশ হিসেবে আমি কথা বলেছি জেলে, মাঝি, ট্রলার মালিক, আড়তদার, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। উপকূলীয় এই জনমানুষের ৯১ শতাংশ জেলে, ৮৯ শতাংশ মাঝি, ৮৭ শতাংশ ট্রলার মালিক এবং ৬৫ শতাংশ আড়তদার একবাক্যে স্বীকার করেছেন, ২০০০ সালের তুলনায় বর্তমানে মাছের প্রাচুর্য ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। একসময় সাগরের বুকে ডলফিনের খেলা, কুয়াকাটা বা কাঁকড়া বিচে সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার দৃশ্য ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। অথচ আজ হাঙর, শাপলাপাতা, করাত মাছ কিংবা হাতুড়ি মাছের মতো প্রজাতিগুলো প্রায় বিলুপ্ত। জীববৈচিত্র্যের এই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য মূলত দায়ী মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘বটম ট্রলিং’ বা তলাবিহীন মাছ শিকার।
সাগরে মাছের এই আকালের নেপথ্যে মূল খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আধুনিক ‘স্টিল বডি ট্রলিং’ বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিশিং এবং স্থানীয় ‘কাঠ বডি ট্রলিং’। তবে এখানে রয়েছে এক অদ্ভুত ও স্ববিরোধপূর্ণ সরকারি নীতি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাগেরহাট বা মহিপুর অঞ্চলে স্টিল বডি ট্রলার নেই; এগুলো মূলত চট্টগ্রামকেন্দ্রিক এবং প্রভাবশালী বিত্তবানদের মালিকানাধীন। এই জাহাজগুলোর জাল অত্যন্ত ছোট ফাঁসের এবং জালের নিচের অংশে প্রায় ৭০-৮০ মণ ওজনের লোহার ভারী পাত বা রোলার বাঁধা থাকে। জাহাজ যখন চলে, তখন এই ভারী লোহা সাগরের তলদেশ চষে বেড়ায়।
জেলেদের ভাষ্যমতে, এই ট্রলিংয়ের ফলে সাগরের তলদেশের উদ্ভিদ, প্রবাল এবং মাছের আবাসস্থল বা ‘ঘরবাড়ি’ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জালের বিস্তৃতি এতটাই ব্যাপক যে, সাগরের তলদেশে একটি মোবাইল ফোন পড়ে থাকলেও তা এই জালে উঠে আসে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু কাঙ্ক্ষিত মাছই নয়, বরং নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে শামুক, ঝিনুক, শঙ্খ, সামুদ্রিক সাপ এবং কচ্ছপসহ হাজারো জলজ প্রাণী। ট্রলিং জাহাজগুলো যখন তাদের জাল তোলে, তখন বিক্রির অযোগ্য ছোট মাছ ও অন্যান্য মৃত প্রাণী সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের তথ্যমতে, ট্রলিং জাহাজের চলার পথের দুই থেকে আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মৃত ছোট মাছের স্তূপ ভেসে থাকে, যার দুর্গন্ধে ওই অঞ্চলে অন্য জেলেদের টেকা দায় হয়ে পড়ে। যে লাখ লাখ পোনা মাছ এভাবে হত্যা করা হচ্ছে, তা জীবিত থাকলে সামুদ্রিক মৎস্য ভান্ডার কতটুকু সমৃদ্ধ হতে পারত, তা সহজেই অনুমেয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, পরিবেশের জন্য চূড়ান্ত ক্ষতিকর এই স্টিল বডি ট্রলারগুলো সরকারিভাবে নিবন্ধিত ও বৈধ। কোস্ট গার্ড বা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, রেজিস্ট্রেশন থাকায় এই জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত এখতিয়ার তাদের সীমিত। অন্যদিকে, স্থানীয় গরিব জেলেদের তৈরি ‘কাঠ বডি ট্রলিং’ বোটগুলোও একই প্রক্রিয়ায় (ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও) সাগরের ক্ষতি করছে। কিন্তু প্রশাসন অবৈধ হওয়ার অজুহাতে এই কাঠের বোটগুলো ভাঙছে, জেলেদের গ্রেপ্তার করছে।
এখানেই রাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির নগ্ন রূপ প্রকাশ পায়। যেই স্টিল বডি ট্রলার সাগরের বাস্তু সংস্থান ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসের মূল হোতা, তারা পাচ্ছে বৈধতা। আর প্রান্তিক জেলেরা, যারা একই অপরাধ ক্ষুদ্র পরিসরে করছে, তারা হচ্ছে নিগৃহীত।
উপকূলের ৯১ শতাংশ মানুষের হাহাকার আর বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের সমন্বয় ঘটালে যে ভবিষ্যৎ দেখা যায়, তা অন্ধকারাচ্ছন্ন। এখনই যদি ‘বটম ট্রলিং’ বা সাগরের তলদেশ চেঁছে মাছ ধরা বন্ধ না করা হয় এবং মৎস্য আহরণ নীতিতে আমূল পরিবর্তন না আনা হয়, তবে ২০ বছর পর বঙ্গোপসাগর শুধু লোনাপানির এক মৃত আধার হয়ে থাকবে।
লেখক : স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়