হোম > মতামত

যুদ্ধের নীরব অস্ত্র যৌন নিপীড়ন

বসনিয়া থেকে সুদান

নাফিসা ল্যাটিক

বসনিয়ায় হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হওয়া একজনের স্বজন। ছবি: সংগৃহীত

বসনিয়া যুদ্ধের পর কয়েক দশক পার হলেও নারী ও শিশুরা এখনো সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। বর্তমানে সেটি ঘটছে আফ্রিকার সংঘাতকবলিত দেশ সুদানে। তবে, এখানে সংঘাতটা হচ্ছে বিপক্ষ কোনো জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে নয়, বরং সশস্ত্র বাহিনীরই দুটি অংশের মধ্যে ক্ষমতার দখল নিয়ে। আর তার মাশুল দিচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। তারা সংঘাতে জড়িত দুই পক্ষেরই যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

১৯৯০-এর দশকে বসনিয়া যুদ্ধের সময় বসনীয় সার্ববাহিনী সেখানের মুসলিম নারীদের ওপর ভয়াবহ যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল।

পূর্ব বসনিয়ার ফোকা শহরের ব্রেনা ভবনে আমি গিয়েছিলাম। সেই কুখ্যাত ভবনটিতে একজন সার্ব সেনা কমান্ডারের একটি ফ্ল্যাট ছিল। যুদ্ধের সময় সেই ফ্ল্যাটে আটকে রাখা একজন মুসলিম নারীর অবস্থা সম্পর্কে আমি স্থানীয় এক টিভি চ্যানেলের জন্য একটি গল্প রেকর্ড করছিলাম। সেখানে ওই নারীর ওপর যা ঘটেছিল, তা ছিল হৃদয়বিদারক। কিন্তু যৌন নিপীড়নের শিকার সেই নারীর চিৎকারের প্রতিধ্বনি সেদিন কারো কানে পৌঁছায়নি।

আমি বসনিয়ায় যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের একজনের আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যও পড়েছি। আদালতের নথিতে তিনি ‘সাক্ষী ৮৭’ নামে পরিচিত এবং ১৯৯২ সালে তিনি ছিলেন ১৫ বছরের একটি মেয়ে। তিনি ফোকার কাছে তার পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। যুদ্ধ শুরু হলে তার জীবনে রাতারাতি চরম বিপর্যয় নেমে আসে। গোলাবর্ষণ এবং গণহত্যা থেকে বাঁচতে তার পরিবার নিকটবর্তী বনে পালিয়ে গেলেও কিছুদিন পর তারা ধরা পড়েন। এরপর পরিবারের পুরুষদের আলাদা করা হয় এবং নারী ও শিশুদের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ক্যাম্পটি পরে যৌন নির্যাতনের জন্য বসনিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত একটি ক্যাম্প হিসেবে পরিচিতি পায়।

আটকের পর সেই মেয়েটি এবং আরেকটি মেয়েকে ৫০০ বসনিয়ান মার্ক বা প্রায় ২৫০ মার্কিন ডলারে কয়েকজন সৈন্যের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। এরপর থেকেই তাকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেসব স্থানে অন্তত একডজন পুরুষ তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালায়। এতে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এবং বেশ কিছুদিন তাকে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। সেসব দিনের কথা মনে করে এখনো সে কানায় ভেঙে পড়ে।

একাডেমিক গবেষণায় দেখা গেছে, যৌন নিপীড়ন যুদ্ধের সময়ের কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি যুদ্ধের একটি অস্ত্র। অনেক গবেষক দেখিয়েছেন, সংঘাতের সময় যৌন সহিংসতা প্রায়ই পদ্ধতিগত হয় এবং মানুষকে আতঙ্কিত করতে ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এলাকাছাড়া করতে নারীদের ওপর যৌন সহিংসতাকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ‘শত্রু’ জনগোষ্ঠীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটি ব্যবহার করে। এটি রাজনৈতিক সহিংসতার একটি রূপ এবং ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি হাতিয়ার।

বহু আগে থেকেই যুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে উপেক্ষা করা হতো অথবা এর প্রভাব কমিয়ে দেখানো হতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটিকে বিচারযোগ্য অপরাধের পরিবর্তে সংঘাতের একটি দুর্ভাগ্যজনক উপজাত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বসনিয়া এবং রুয়ান্ডার যুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার চিত্র সামনে আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। সাবেক যুগোস্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং রুয়ান্ডার জন্য গঠিত একই ধরনের ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক আইনে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে যৌন সহিংসতা এবং দাসত্বকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

যুগান্তকারী ফোকা মামলায় যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যৌন অপরাধকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রথমবারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ফোকা এবং এর আশপাশের এলাকায় নারী ও কন্যাশিশুদের আটকে রেখে যৌন নির্যাতন শিবির পরিচালনার জন্য ২০০১ সালে তিন সার্ব তিন সার্ব সেনা কুনারাক, কোভাক এবং ভুকোভিচকে সাজা দেয় আদালত। এদের হাতে আটক থাকা মুসলিম নারী ছাড়াও ১২ বছরের কমবয়সি কয়েকজন মেয়েও ছিল। তাদেরও সৈন্যদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে ৩৫,০০০-এর বেশি নারী ও মেয়ে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছিল। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছে, মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য ধর্ষণকে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল সার্ববাহিনী। ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এই অপরাধগুলো কোনো একজন সৈন্যের বিচ্ছিন্ন কাজ ছিল না, বরং তা ছিল যৌন নিপীড়নের একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ।

আদালতের এই রায় ছিল যুগান্তকারী। প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক আদালত যৌন অপরাধকে কোনো গৌণ বা ‘ছোট’ অপরাধ হিসেবে নয়, বরং যুদ্ধের একটি হাতিয়ার এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এটিকে আইনি পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করেছে, সশস্ত্র সংঘাতের জবরদস্তিমূলক পরিবেশের ওপর জোর দিয়েছে। তবে, আন্তর্জাতিক আইনে এই অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনো অপরাধীদের দায়মুক্তি অব্যাহত রয়েছে।

গত ৩০ বছরেও এই পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সুদানের নারীরা কয়েক দশক ধরেই বসনিয়ার মতো একই দুঃস্বপ্নে দিন কাটাচ্ছেন। দেশটির দারফুর অঞ্চলে সহিংসতার সর্বশেষ ঘটনায় হাজার হাজার নারী তাদের মায়েদের দুঃস্বপ্নের দিনগুলোর মতোই একই পরিস্থিতিতে পড়ছেন। বর্তমানে সেখানে অসংখ্য নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সেখানে পুরো সম্প্রদায়কে নির্মূল করার জন্য যৌন নির্যাতনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে সামাজিক কাঠামো তাদের ঐক্যবদ্ধ করে রাখে, যৌন নিপীড়নের মাধ্যমে সেটাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এটাকে ‘একটি সন্ত্রাসী তৎপরতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের যৌন সহিংসতা যুদ্ধের সবচেয়ে অদৃশ্য অস্ত্র হিসেবে রয়ে গেছে এবং পুরো মাত্রায় তা ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি কিংবা শান্তি আলোচনায় প্রায় সময়ই এই গুরুতর ইস্যুটি অনুপস্থিত থাকে, আলোচনার এজেন্ডায় স্থান পায় না। বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেন। এই দুঃসহ স্মৃতি নারীদের জীবনকে একেবারে ধ্বংস করে দেয় এবং যারা বেঁচে যান তারা তাদের হারানো মনোবল আর কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারেন না। এই নারীরা যে শুধু সমবেদনা নয়, ন্যায়বিচার পাওয়ারও যোগ্য, তা বিবেচনা করা হয় না।

সুদানের দারফুর অঞ্চলে ন্যায়বিচার আগের চেয়ে এখন অনেক দূরের বিষয়। আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) উত্তর দারফুরের এল-ফাশার শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখান থেকে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ নিকটবর্তী শরণার্থীশিবিরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। আর অবরুদ্ধ শহরটিতে আটকে পড়া হাজার হাজার মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছেন। সেখানে বহু মানুষকে হত্যা এবং নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। সাহায্য সংস্থাগুলো এল-ফাশারে ব্যাপক নৃশংসতার কথা জানিয়েছে। সেখানে হাসপাতালগুলোকেও টার্গেট করে হামলা চালানো হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হাসপাতালগুলোয় কমপক্ষে ৪৬০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্বের উদাসীনতার মধ্যে সেখানে নির্যাতিত নারীদের কণ্ঠস্বর হারিয়ে যাচ্ছে।

বসনিয়ার ফোকা শহরের ‘সাক্ষী ৮৭’-এর কথা আমার মনে পড়ে। আমি আশা করি, তিন ধর্ষক সেনার বিচারের ঘটনায় কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন ধর্ষিতা ওই নারী। আমি তাকে নীরবে ধন্যবাদ জানিয়েছি এই কারণে যে, সে সাহস করে কথা বলেছে এবং আদালতকে তাদের কাজ করতে সহায়তা করেছে। সে যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইতিহাস পরিবর্তন করতে এগিয়ে এসেছে। বননিয়ার সংঘাতের তিন দশক পর এখন সুদানি নারীরা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়েরা লজ্জায় নীরব রয়েছেন। কারণ বিশ্ববিবেক তাদের বিষয়ে উদাসীন, তাদের অমানবিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করছে পুরো বিশ্বই।

ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

স্বৈরশাসকদের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

ভূমিকম্পের মাত্রা যদি আরেকটু বেশি হতো!

পাহাড়ে নতুন ষড়যন্ত্র

বিনোদনের বিপ্লব ও জেন-জি সংস্কৃতি

বামপন্থা ও স্বৈরাচার

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের দ্বিধা

ভোট কারচুপি রোধে প্রয়োজন সিসি ক্যামেরা