বৃহস্পতিবার রাতে, ১৯৭১-এর অসমাপ্ত অঙ্গীকার আর জুলাই ৩৬-এর জাগ্রত বিবেকের মতো ভারী এক মৃত্যু ইতিহাসের বুকে আছড়ে পড়েছে। সে মৃত্যু শুধু একটি তরুণ প্রাণের নিভে যাওয়া নয়—এ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিযাত্রার এক ভয়ংকর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক নৈতিক প্রদীপের নিভে যাওয়া। এক ভীতিকর ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে—যেখানে ১৯৭১-এর রক্তস্নাত স্বপ্ন আর জুলাই ৩৬-এর জাগ্রত প্রত্যয় ফ্যাসিবাদের দমবন্ধ করা আঁধারে হাঁপিয়ে উঠছে—যে বুক একদিন অবিচল প্রতিবাদে ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, আজ সেই বুক নিথর, নীরব, নিস্তব্ধ।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদি আর নেই
সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালের শয্যায় তার প্রস্থান কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। এটি একটি রাজনৈতিক শূন্যতা, একটি নৈতিক ভাঙন, এমন এক অন্ধকারের অবতরণ—যে মুহূর্তে একটি জাতির সবচেয়ে বেশি আলো প্রয়োজন ছিল। এ মৃত্যু শুধু একজন মানুষকে নেয়নি; নিয়ে গেছে সাহসের একটি স্তম্ভ, সত্যের একটি উচ্চারণ।
দেশের মাটি থেকে বহু দূরে তার শরীর যখন ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল, তখনো তার বিবেক বাংলার রাজপথ ছেড়ে যায়নি। দূরত্ব তাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি মানুষের দুঃখ থেকে, বঞ্চনার আর্তনাদ থেকে, নজরদারিতে থাকা নাগরিকের নিঃশ্বাস থেকে। তিনি ছিলেন—দূর থেকেও—অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অটল উপস্থিতি, এক অদৃশ্য পাহারাদার।
জুলাই ৩৬-এর সন্তান, ১৯৭১-এর শপথে দীপ্ত
শরীফ ওসমান হাদি ভয়কে উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি উঠে এসেছিলেন ভাঙনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক প্রজন্ম থেকে—যে প্রজন্ম প্রশ্ন করতে শিখেছিল, মাথা উঁচু করতে শিখেছিল। জুলাই ৩৬ কোনো নিছক আন্দোলন ছিল না; তা ছিল বিবেকের বিস্ফোরণ, নীরবতার বিরুদ্ধে উচ্চারণ, কৃত্রিম স্বাভাবিকতার মুখে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা।
হাদি ছিলেন সেই বিস্ফোরণের নৈতিক কেন্দ্র। বহু মানুষ যা অনুভব করেছিল কিন্তু উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি, তিনি তার ভাষা হয়ে উঠেছিলেন।
তার কাছে জুলাই ৩৬ কখনোই ১৯৭১ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল না কোনো সমাপ্ত ইতিহাস—ছিল এক অসমাপ্ত দায়। রক্ত দিয়ে অর্জিত সার্বভৌমত্ব নীরবতার দরকষাকষিতে বিকিয়ে দেওয়া যায় না। আত্মত্যাগে অর্জিত মর্যাদা সুবিধার ভাষায় খর্ব করা যায় না। এই বিশ্বাসেই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন—একাই হোক, নির্ভীকভাবে।
সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক নীরব যুদ্ধ
হাদি জানতেন, ফ্যাসিবাদ সবসময় বুটের শব্দে আসে না। অনেক সময় তা আসে সংস্কৃতির মুখোশ পরে—স্মৃতিকে বিকৃত করে, ইতিহাসকে শাসন করে, পরিচয়কে সংকুচিত করে। তিনি সেই সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন গভীর বোধ ও স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে।
যে বয়ান আত্মসমর্পণকে স্বাভাবিক করে তোলে, আনুগত্যকে গুণ বানায়, আর প্রশ্নকে অপরাধে পরিণত করে—হাদি সেসব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার কাছে সংস্কৃতি ছিল না উৎসবের সাজ; ছিল প্রতিরোধের অস্ত্র।
যখন নীরবতা হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রীয় কৌশল
প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানের পর আসে এক ভয়ংকর সময়—যখন বিপদ আরো সূক্ষ্ম হয়। ইতিহাস বলে, রাজপথ নীরব হলেই ক্ষমতা পরাজিত হয় না; বরং তিন নিজেকে নতুন রূপে সাজান। ভয় ফিরে আসে মোলায়েম মুখোশে।
শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন সেই বিপ্লবীদের একজন—যারা সংগ্রাম টিকিয়ে রাখলেও পরবর্তী পাল্টা-বিপ্লবের মুখোমুখি হন। জুলাই-৩৬-এর পর তিনি নজরদারি দেখেছেন, একাকিত্ব দেখেছেন, ভয়ভীতির স্বাদ পেয়েছেন। তবু তিনি ভুলে যাননি কেন সেদিন মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। আর সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরাই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। তার মৃত্যু তাই শুধু ব্যক্তিগত শোক নয়—এটি ইতিহাসের একটি সতর্কঘণ্টা। বিপ্লবের পরবর্তী অধ্যায়ই প্রায়শ সবচেয়ে প্রতারণামূলক, সবচেয়ে নিষ্ঠুর।
গণতন্ত্র : স্লোগান নয়, দৈনন্দিন মর্যাদা
হাদি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র কোনো দেয়াললিখন নয়। এটি মানুষের দৈনন্দিন মর্যাদা—ভয়হীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার, গুমের আশঙ্কা ছাড়াই কথা বলার স্বাধীনতা, শাস্তির আতঙ্ক ছাড়াই ভিন্নমত প্রকাশের সাহস।
এই বিশ্বাস থেকেই তিনি রাজপথে নেমেছেন, আন্দোলন গড়েছেন, তরুণদের সংগঠিত করেছেন। দমন-পীড়ন তাকে অনুসরণ করেছে, হুমকি তার চারপাশে ঘুরেছে। তবু তিনি থামেননি—কারণ তার সংগ্রাম কখনোই নিজের জন্য ছিল না; ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্নে প্রোথিত।
তিনি অসম ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, সার্বভৌমত্বের নীরব ক্ষয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, নির্ভরশীলতাকে স্বাভাবিক করার রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন।
হাদির সবচেয়ে বড় অবদান স্লোগান নয়—সাহস। যারা প্রথমবার রাজপথে নামতে ভয় পেত, তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যাদের কণ্ঠ ফিসফিসে হয়ে গিয়েছিল, তিনি সেখানে দৃঢ়তা ঢেলে দিয়েছেন। তিনি ভয়কে রূপান্তর করেছেন সংহতিতে।
তার সাহস ছিল না প্রদর্শনের জন্য। তিনি জানতেন এর মূল্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে। জানতেন, এই পথ জীবনও দাবি করতে পারে। তবু তিনি পিছু হটেননি—কারণ ইতিহাস কখনো নিরাপদ মানুষের কাঁধে ভর করে এগোয় না।
তরুণদের প্রতি শেষ কিন্তু স্থায়ী আহ্বান
বাংলাদেশের তরুণদের প্রতি—এই মুহূর্তটি এখন তোমাদের। শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু কোনো সমাপ্তি নয়; এটি ইতিহাসের পক্ষ থেকে দেওয়া এক কঠিন প্রশ্ন। তিনি যে সাহস রেখে গেছেন, তোমরা তার কী করবে?
ভয়কে কি আবার রাজপথ দখল করতে দেবে?
নাকি ১৯৭১-এর অসমাপ্ত অঙ্গীকার আর জুলাই ৩৬-এর জাগ্রত বিবেককে সামনে এগিয়ে নেবে?
তাকে শুধু একটি ছবি, একটি নাম, একটি নিরাপদ ফিসফিসে স্মৃতিতে পরিণত করো না। নীরবতা প্রত্যাখ্যান করে, যেখানে মর্যাদা অস্বীকৃত হয়, সেখানে তা রক্ষা করে আর আত্মসমর্পণকে যখন টিকে থাকার শর্ত হিসেবে হাজির করা হয়—তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই তাকে সম্মান জানাবে।
শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু আমাদের কাঁদানোর জন্য নয়—আমাদের জাগানোর জন্য। ইতিহাস সাক্ষী, যারা সত্যের পক্ষে বুক পেতে দেয়, তারা সংখ্যায় কম হলেও সময়কে বদলে দেয়। হাদির জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়ে শেষ হয়ে যায় না; তাকে প্রতিদিন রক্ষা করতে হয়, প্রতিদিন প্রশ্ন করতে হয়, প্রতিদিন সাহস জাগাতে হয়। আজ যদি এই মৃত্যু আমাদের আরেকটু চুপ করিয়ে দেয়, তবে সেটাই হবে তার প্রতি সবচেয়ে বড় অবমাননা। আর যদি এই শোক আমাদের কণ্ঠকে আরো দৃঢ় করে, চোখকে আরো সতর্ক করে, হৃদয়কে আরো অনড় করে তোলে—তবেই শরীফ ওসমান হাদি ইতিহাসে হারাবেন না। তিনি তখন আর একজন মানুষ থাকবেন না; তিনি হয়ে উঠবেন এক অবিরাম উচ্চারণ, যা আমাদের বিবেককে বারবার জিজ্ঞেস করবে : আমরা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম, নাকি নিরাপত্তার অজুহাতে নীরবতা বেছে নিয়েছিলাম?
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সাভান্না স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক