হোম > মতামত

আফগানিস্তান-পাকিস্তান: বন্ধুত্ব ও ষড়যন্ত্র

সুমাইয়া সুলতানা তামীমা

একসময় আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছিল একে অন্যের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় তারা যেন ছিল দুই ভাই, একে অন্যের দুঃসময়ের আশ্রয়। বিশেষ করে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়, পাকিস্তান আফগান মুজাহিদিনদের পাশে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

সে সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হক। একজন সামরিক শাসক যিনি ইসলামি ঐক্যের আদর্শে বিশ্বাসী, তিনি আমেরিকার সহযোগিতায় আফগান মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দেন। এই সহযোগিতার মাধ্যমেই পাকিস্তান হয়ে ওঠে আফগান যুদ্ধের ঘাঁটি। লাখ লাখ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নেন এবং পাকিস্তানকে তখন দেখা হতো ইসলামি দুনিয়ার রক্ষাকবচ হিসেবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় ঠিক এ সময়েই ঘটে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনা।

১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট, বাহাওয়ালপুরের আকাশে একটি সি-১৩০ সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমানে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড রাফেল, মার্কিন জেনারেল হারবার্ট ওয়াসম এবং পাকিস্তানের কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বিস্ফোরিত হয়ে সবাই নিহত হন। পরে তদন্তে ধারণা করা হয়, বিমানের ভেতরে বোমা বা বিষাক্ত গ্যাস ছাড়া হয়েছিল, যা পাইলটদের অচেতন করে। এই রহস্যময় হত্যাকাণ্ডকে পরে অনেকে ‘Operation Z’ নাম দেয়। যেখানে ‘Z’ মানে ছিল Zia। জিয়ার মৃত্যু হয় সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। সোভিয়েত সেনাদের কৌশলে।

জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের রাজনীতি এক নতুন মোড় নেয়। ১৯৯০-এর দশকে তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসে এবং তাদের পেছনে পাকিস্তানের বড় ভূমিকা ছিল। তখনো দুই দেশের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ।

২০০১ সালে আল-কায়েদার সূত্র ধরে আমেরিকা শুরু করে ‘ওয়ার অন ট্যারর’ (War on Terror)।

তালেবান সরকার তখন ক্ষমতায়। আমেরিকা ও এর মিত্ররা আফগানিস্তানে সেনা পাঠায়। তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও দেশ শান্ত হয়নি। চলে ভয়াবহ যুদ্ধ, টোটাল দেশ হয় রণক্ষেত্র। আবার সাধারণ মানুষ আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের শরণার্থীশিবিরে। পাকিস্তান এবার তালেবানদের প্রতি তেমন উচ্চবাচ্য না করে নীরব সমর্থন দেয়। এই অবস্থান থেকে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক অবিশ্বাস। আফগান সরকার অভিযোগ করে, তালেবানদের আশ্রয় দিচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তান বলে আফগানরা ভারতের সঙ্গে মিলে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আমেরিকার চাপ বাড়ে, যার ফলে অন্যদের মতো ইমরান খান মুসলিম জাতীয়তাবাদী হওয়ায় তার শাসনও রক্ষা করা যায়নি।

২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের পর, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আবার ক্ষমতায় আসে এবং আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহার করে। আজ সেই দুই ‘ভ্রাতৃরাষ্ট্র’, একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

ডুর‍্যান্ড লাইন (Durand Line) নিয়ে সীমান্ত সংঘর্ষ, বাণিজ্য ও ভিসা সংকট আর ভারতের সঙ্গে আফগান সরকারের সম্পর্ক, সব মিলিয়ে এখন দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় যুদ্ধাবস্থায়। যে আফগানিস্তান একসময় পাকিস্তানের সহায়তায় সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিল, আজ সেই আফগানরা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করছে। ধারণা করা যায়, পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলতে ভারত এই পরিস্থিতিতে ঘি ঢালছে। অর্থাৎ শত্রুর শত্রু-বন্ধু। এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক পরিহাস। যেখানে সহযোগিতা রূপ নিয়েছে সন্দেহে আর বন্ধুত্ব পরিণত হয়েছে শত্রুতায়। রাজনীতির দুনিয়ায় কেউ চিরকাল বন্ধু নয়, কেউ চিরকাল শত্রুও নয়, শুধু স্বার্থই স্থায়ী। কিন্তু এই স্বার্থের খেলায় হারিয়ে যায় সেই মানবিক সম্পর্ক, যা একসময় ধর্ম, ভাষা ও ইতিহাসের বাঁধনে গাঁথা ছিল।

আজও সীমান্তের দুই পাশে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যাদের রক্ত, ভাষা আর স্বপ্ন এক ছিল। তারা যুদ্ধ চায় না, তারা শুধু সেই পুরোনো দিনের মতো শান্তি চায়, যখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অন্যকে ‘ভাই’ বলে ডাকত আর প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক সেই ভ্রাতৃত্বের প্রতীক ছিলেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড : ভারত ও হাসিনার প্রতিশোধ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেষ জননন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া

গণতন্ত্র ধার করার প্রয়োজন নেই আফ্রিকার

ছয় কোটি নতুন মুখ দারিদ্র্যসীমার ঝুঁকিতে কেন?

বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ও বাস্তবতা

সংবিধানে ‘বিসমিল্লায় গলদ’

অর্থহীন হয়ে গেছে ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন

খালেদা জিয়ার প্রতীক্ষায় জাপানের চেরি ফুল

কপ-৩০ সম্মেলন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বন্দর ব্যবস্থাপনা : ভারতের বয়ানে সমালোচনা