হোম > মতামত

উত্তরবঙ্গের তাঁতপল্লি : নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব

রাকিবুল ইসলাম

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্রকে যদি ঘেঁটে দেখা যায়, তবে উত্তরবঙ্গের বগুড়ার শাঁওইল গ্রামের তাঁতপল্লি যেন এক নীরব বিপ্লবের সাক্ষী। এই গ্রামে কেবল কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা তাঁতশিল্প নয়, বরং এক সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে, যা গ্রামের হাজারো মানুষকে জীবিকার নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে। আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের ছোট এই গ্রামে তাঁতশিল্প কেবল হস্তশিল্পের চর্চা নয়, এটি গ্রামের অর্থনৈতিক চক্রের প্রাণ।

শাঁওইল তাঁতপল্লি শুধু স্থানীয় বাজারের জন্য নয়, দেশের বৃহত্তর অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। ঢাকার গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে বাতিলকৃত ঝুট কাপড় এখানে আসে। এই কাপড়গুলো বাছাই করে হস্তচালিত তাঁতে সুতা তৈরি করা হয়, তারপর রঙ ও ববিনিং করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী এখানে এসে সুতা ও তাঁতপণ্য ক্রয় করেন। এই প্রসেসের মধ্যে স্থানীয় তাঁতিরা কেবল উৎপাদক নয়, তারা শিল্পের মূল চালিকাশক্তি। প্রতিটি পরিবারে ১ থেকে ৫টি তাঁত থাকে, যেখানে বৈদ্যুতিক বা প্রাচীন কাঠ-বাঁশের তাঁতে বছরের পর বছর ধরে পণ্য তৈরি হচ্ছে।

শাঁওইল তাঁতশিল্পে উৎপাদিত চাদর, কম্বল, গামছা এবং তোয়ালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে উন্নত মানের চাদর রপ্তানি পর্যন্ত হচ্ছে। এমনকি সরকারি বা বেসরকারি কোনো সাহায্য ছাড়া এই বাজার নিজেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শাঁওইলের হাটে দোকানের সংখ্যা শুরুতে মাত্র পাঁচটি ছিল, আজ তা প্রায় আড়াই হাজারে পৌঁছেছে। এই বর্ধিত বাণিজ্য শাঁওইলকে শুধু অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক মিলনের কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত করেছে।

শাঁওইল তাঁতশিল্পের অর্থনৈতিক প্রভাব শুধু গ্রামীণ অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। আশেপাশের শতাধিক গ্রামের প্রায় ৮০০ তাঁতি পরিবার এবং লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাদের প্রতিদিনের শ্রম এবং বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত কারিগরি দক্ষতা বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অদৃশ্য ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।

এই শিল্পের মূল চালিকাশক্তি নারীর শ্রম। নারীরা সুতা বুনন, রঙ করা, ফেটি তৈরি এবং প্যাকিংসহ যাবতীয় কাজে অংশগ্রহণ করে। এটি নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বাড়ায় এবং সমাজে মর্যাদা নিশ্চিত করে। যুবকেরাও গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যেখানে তাঁরা স্বনির্ভর হয়ে সংসার চালাচ্ছে, পরিবারকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে শ্রম সমন্বয় করা হয়, যাতে গ্রামীণ শিক্ষার ক্ষতি না হয়।

শাঁওইলের উৎপাদনশীলতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শীতকালে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ কম্বল, এক কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি করা হয়। পাইকারি বাজারে চাদরের দাম ১০০ থেকে এক হাজার টাকা, কম্বল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা, এবং গামছা বা তোয়ালের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

শাঁওইল তাঁতশিল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংহতির প্রতীক। প্রতিটি তাঁতের খটখট শব্দ, সুতার বুনন এবং কারিগরের শ্রম গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। শাঁওইলের প্রতিটি বাড়ি যেন এক জীবন্ত কর্মশালা।

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখানে সীমিত হলেও আধুনিক যন্ত্র সংযোজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আধুনিক ববিনিং মেশিন, রঙ মেশিন, ডিজিটাল নকশা এবং দ্রুত বুনন যন্ত্র সংযোজন করলে উৎপাদনের মান ও পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। তবে প্রাচীন কারিগরি দক্ষতা সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক বাজারে শাঁওইলের তাঁতপণ্য প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। বিশেষ করে হ্যান্ডমেড, ইকো-ফ্রেন্ডলি এবং রিসাইকেলড সুতা থেকে তৈরি পণ্য ক্রেতার কাছে আকর্ষণীয়। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন মানদণ্ড, সার্টিফিকেশন, আধুনিক প্যাকেজিং এবং লজিস্টিক সুবিধা।

সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য। ব্যাংকিং সুবিধা, ঋণ, অনুদান, আধুনিক অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, প্রযুক্তি সংযোজন এবং রপ্তানি সহায়তা—এসব মিলে শাঁওইল তাঁতশিল্পকে টেকসই ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব।

তবে শাঁওইল বাজার এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সরকারি কোনো ব্যাংক নেই, বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থাও সম্পূর্ণ কার্যকর নয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই, হাটের জায়গায় ছাউনি নেই, ঝড়-বৃষ্টি সহ্য করতে হয়। পুলিশ বক্স, আধুনিক হাটশেড ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন করলে বিক্রেতা নিরাপদে বেচাকেনা করতে পারবে এবং ক্রেতারাও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবে।

শিল্পটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পণ্য কারিগরের দক্ষতা এবং গ্রামের ঐতিহ্য বহন করে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংহতি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ও রক্ষা করে। সরকারের উদ্যোগে উন্নয়ন প্রকল্প, প্রযুক্তি সংযোজন এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানির ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শাঁওইল তাঁতশিল্প দেশের অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে এবং আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতি অর্জন করবে।

শাঁওইলের তাঁতশিল্প একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নীতিমালার মাধ্যমে টেকসই করা সম্ভব। প্রতিটি খটখট শব্দ, শ্রমিকের পরিশ্রম এবং উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যই বাংলাদেশের নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লবের গল্প বলে। এই শিল্প দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

গৃহবধূ থেকে দেশনেত্রী: এক সংগ্রামমূখর জীবনের আলেখ্য

নতুন বছরে যেসব ইস্যু মধ্যপ্রাচ্যকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে

ওসমান হাদি হত্যা ও আজাদির লড়াই

মব, গণআদালত থেকে পোস্ট-শাহবাগ

জাতীয় ঐক্যের এক অনন্য সুযোগ ও আমাদের দায়বদ্ধতা

নয়া বন্দোবস্তে ওসমান হাদির জবানবন্দি

যেভাবে ভারতকে বদলে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা

নির্বাচন হতে যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ

একজন সেলজুক বায়রাকতার ও আমাদের মেধাবী তরুণরা

নয়া জমানার মুয়াজ্জিন ওসমান হাদি