হোম > মতামত

নতুন বিপ্লব, পুরোনো অভ্যাস : গণমাধ্যম কি বদলাতে পারবে?

শিবলী সোহায়েল

প্রতীকী ছবি

এক ভার্চুয়াল আলোচনায় লন্ডনপ্রবাসী অধ্যাপক তৈমুর শরীফ সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের উদ্দেশে, ‘এরপর যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং তারা যদি আওয়ামী লীগের মতো একই রকম ফ্যাসিবাদী আচরণ করে, তাহলে আপনাদের ভূমিকা কী হবে?’

সময়টা ছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনকাল। বাংলাদেশের মানুষ তখন গণমাধ্যমসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার দাসত্ব করতে দেখে হতাশ। আলোচনা চলছিল সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভের একটি ওয়েবিনারে। আলোচনার বিষয় ছিল ফ্যাসিবাদের কবল থেকে উত্তরণ ও প্রবাসীদের করণীয়। আমি ছিলাম সঞ্চালকের ভূমিকায়। ভাবছিলাম, সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সাহেব এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন। দেখলাম তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বললেন, ‘আমাদের ভূমিকা একই থাকবে। আমরা জনগণের পক্ষেই কথা বলব। কেউ যদি দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের বাইরে কোনো কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই একইভাবে জারি থাকবে।’

জুলাই বিপ্লবের পর গত বছর ডিসেম্বরে ‘আমার দেশ’ আবার নতুন করে চালু হলো। বিপ্লবের পর দেশে নতুন এক রাজনৈতিক রূপান্তরের টালমাটাল সময়। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সংবাদমাধ্যমগুলোও তাদের বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু দেশের একটি বড়সংখ্যক গণমাধ্যম আসন্ন ক্ষমতাসীন পক্ষকে খুশি করতে এখন থেকেই তোষামোদ শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল ‘আমার দেশ’। গত এক বছর তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে পাঠকরা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তাঁর কথা রেখেছেন। তিনি তাঁর ‘আমার দেশ’ টিম নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন, কাউকে ছাড় দেননি। আর তাই গত ১৯ অক্টোবর বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় অফিসে ‘আমার দেশ’ সাংবাদিক নগ্ন আক্রমণের শিকার হলেন।

মাহমুদুর রহমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করেন, এটা সবারই জানা। কিন্তু পাঠকরা নিশ্চয়ই সাংবাদিকতার ময়দানে তাঁর ও ‘আমার দেশ’ টিমের নিরপেক্ষতা, দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের নজিরই দেখতে পান। ঠিক যেমন ফুটবল খেলায় একজন ধারাভাষ্যকার বা রেফারি ব্যক্তিগত জীবনে মোহামেডান, আবাহনী বা যেকোনো দলের সমর্থক হতে পারেন, কিন্তু ম্যাচে রেফারি বা বিশ্লেষক হিসেবে তার কাজ হচ্ছে পক্ষপাতহীন দায়িত্ব পালন। অন্যথায়, শুধু খেলাটাই নষ্ট হয় না, খেলোয়াড় ও দর্শকদের বিশ্বাস ভেঙে যায় এবং পুরো ক্রীড়াব্যবস্থার প্রতিই আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাই। ব্যক্তিগত মত থাকতেই পারে, তবে পক্ষপাত নয়। সংবাদ পরিবেশনের সময় ব্যক্তিগত মতকে পাশে সরিয়ে রেখে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হয়। একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে হয়। সাংবাদিকতা তার দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হলে জনগণ শুধু আস্থাই হারায় না, একটি জাতি বা রাষ্ট্রের মূল কাঠামোও ভেঙে যায়।

আসুন, এবার দেখা যাক অপসাংবাদিকতা কীভাবে একটি রাষ্ট্রকাঠামোতে আঘাত হানতে পারে। একটি রাষ্ট্রকাঠামো মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত : ১. সরকার, ২. বণিক বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ৩. জনগণ।

প্রথম দুটি অঙ্গ, অর্থাৎ সরকার ও বণিকগোষ্ঠী, তৃতীয় অঙ্গে (জনগণ) চেয়ে স্বভাবতই অধিক ক্ষমতাবান হয়ে থাকে। সরকার তার পুলিশ, প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে প্রবল ক্ষমতাবান। আর ওদিকে বণিক বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে আছে বিপুল অর্থের জোর। অন্যদিকে জনগণের একমাত্র সম্বল তার কণ্ঠ আর গণমাধ্যম হচ্ছে জনগণের এই কণ্ঠের কণ্ঠস্বর। জনসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও যদি তার কণ্ঠস্বর, অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম, তার দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে সরকার অথবা বণিকদের প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়, তাহলে সমাজের এই তৃতীয় অঙ্গটি দুর্বল হয়ে পড়ে।

ঠিক যেমন একটি রাষ্ট্রের তিনটি পা সরকার, বণিক ও জনগণ। এর মধ্যে যেকোনো একটি পা যদি অক্ষম অথবা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সেই রাষ্ট্র খোঁড়া হয়ে যেতে বাধ্য। দেড় দশক ধরে এই তৃতীয় পাটিকে মেরে, কেটে, গুম করে, তার ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে শুধু নিস্তেজ করাই হয়নি, পুরো দেশটাকেই খোঁড়া করে ফেলা হয়েছিল। আর জনগণের কণ্ঠস্বর গণমাধ্যম, এই বোধ ও চর্চার অভাবে শুধু তার বিশ্বাসযোগ্যতাই হারায়নি, বরং রীতিমতো ফ্যাসিবাদী সরকার ও লুটেরা বণিকদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল।

সাংবাদিকতার মূলনীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকান প্রেস ইনস্টিটিউটের মতে, ‘সাংবাদিকতার প্রথম আনুগত্য নাগরিকদের প্রতি’ এবং এটি অবশ্যই রাষ্ট্র ক্ষমতার একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক বা ‘ওয়াচ ডগ’ হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস! দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম এই উদ্দেশ্য ও অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে রীতিমতো ‘বাইজি’তে পরিণত হয়েছিল। শিল্পী (Artist) ও বাইজির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটি হলো উদ্দেশ্য ও অবস্থান। যখন কোনো শিল্পী এই মৌলিক উদ্দেশ্য ও অবস্থান থেকে বিচ্যুত হন, তখন তিনি আর শিল্পী থাকেন না; তিনি পরিণত হন বাইজিতে। বাইজি হলো সেই পণ্য, যে শক্তি ও সম্পদের ফাঁদে অসহায় শিকার হয়ে রাজরাজড়া ও ক্ষমতাবানদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচে।

অনুরূপভাবে, যে সাংবাদিক জনগণকে বাদ দিয়ে অত্যাচারী সরকারের অনুগত হন, সরকারের ‘ওয়াচ ডগ’ না হয়ে তাদের ‘পোষা ডগ’ হিসেবে কাজ করেন অথবা মাফিয়াদের উচ্ছিষ্টভোগী হন—তাকে কি ‘বাইজি সাংবাদিক’ বলা ভুল হবে? যারা সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট এবং জনগণের ওপর অত্যাচারের বৈধতা দিতে গিয়ে অনুগত দাসের মতো আচরণ করেন, তারা সাংবাদিকতার মর্যাদা হারান। এই কারণে সমাজের মানুষ তখন তাদের ‘বুদ্ধি-বেশ্যা’ নামে অভিহিত করত। আর আমি এই গোষ্ঠীকেই ‘বাইজি সাংবাদিক’ নামে আখ্যা দিচ্ছি।

এই বাইজি সাংবাদিকতাই ফ্যাসিবাদকে এত বছর জিইয়ে রেখেছিল, অলিগার্ক বণিকদের জন্য লুটের পথ উন্মুক্ত রাখতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। কিন্তু সেসব তো ছিল অতীতের কষ্টের কথা। আমাদের এখনকার ভাবনা হলো : বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হবে। তারা কি পারবে তাদের পুরোনো অভ্যাস পরিবর্তন করে গণমাধ্যমের জন্য নতুন সংস্কৃতি গড়তে? তারা কি পারবে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবর্তনে সঠিক ভূমিকা রাখতে? নাকি আগের মতোই, প্রচার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা এবং অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার লোভে, অসুস্থ বিতর্ক উসকে দেবে আর ক্ষমতার পদলেহন করবে?

৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান শুধু ক্ষমতার পটপরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রকে আমূল পরিবর্তনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছে। দীর্ঘকাল ধরে আমাদের রাজনীতিকে গ্রাস করে রেখেছিল এক অসুস্থ সংস্কৃতি, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—দলবাজি, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, লুটপাট এবং ঘৃণার চাষ। এই সংস্কৃতি সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব জন্ম নেওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল।

কিন্তু বিপ্লবের পরপরই দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন যেন আমাদের নতুন সংস্কৃতির আলোকরেখা দেখাল। সেখানে ছিল না কোনো গোলাগুলি বা পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। এই নির্বাচনগুলো প্রমাণ করেছে, আমাদের তরুণ সমাজ বিভক্তি-বিদ্বেষ-হানাহানি দূর করে সত্য, সাহস, সেবা আর সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। এগুলো শুধু নির্বাচন ছিল না, বরং ছিল একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন—যেখানে ভিন্নমত থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু সবকিছু হবে শালীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে।

নব-সংস্কৃতির এই আলোকরেখা এগিয়ে নিতে ও প্রজ্বালিত রাখতে এবং জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকাশের গুরুদায়িত্বে এখন মিডিয়াকে মূল কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করতে হবে। মিডিয়াকে একই সঙ্গে ভালোকে ভালো বলে মূল্যায়ন করতে হবে এবং ক্ষমতার রন্ধ্রে থাকা সব অন্যায়কারীকে, তারা যেই হোক না কেন, কঠোর জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। পুরোনো অভ্যাস ঝেড়ে ফেলে ‘বাইজি’ সাংবাদিকতাকে পরিহার করতে হবে।

তবে সাংবাদিকতার পথ মোটেই সহজ নয়, অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ। ‘আমার দেশ’-এর গত ১৫ বছরের ভয়াবহ সংগ্রামের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি এই চলা কঠিন হলেও বিশাল সম্মানের। আমার দেশ-এর এই দীর্ঘ লড়াই সব গণমাধ্যমের অনুপ্রেরণা হতে পারে। যখন সবাই ফ্যাসিবাদের ভয়ে কম্পমান অথবা ক্ষমতার চাটুকারিতায় ব্যস্ত, তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একটি সংবাদপত্র কীভাবে তাদের ভূমিকা রেখেছিল, তার কয়েকটি নজির নিচে দেওয়া হলোÑ

  • গণজাগরণের নামে ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উন্মোচন : ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের নামে পরিকল্পিত ‘ম্যাস-হিস্টিরিয়া’ বা গণ-উন্মাদনার বিরুদ্ধে একাই লড়েছিল ‘আমার দেশ’। তারা সাহস করে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনাম করেছিল, যা ফ্যাসিবাদী এই উন্মাদনার চেহারা সবার সামনে তুলে ধরেছিল।
  • উগ্র ধর্মবিদ্বেষের মুখোশ উন্মোচন : ব্লগারদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে লুকিয়ে রাখা উগ্র ধর্মবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক চেহারা উন্মোচন করে দিয়েছিল। এটি ছিল সে সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ‘ঘৃণার চাষ’-এর বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত।
  • বিচারিক মঞ্চে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের স্বরূপ উন্মোচন : ফ্যাসিবাদী শাসনামলে আদালতসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির মুখোমুখি করার সামর্থ্য একমাত্র ‘আমার দেশ’ই দেখাতে পেরেছিল। বহুল আলোচিত ‘স্কাইপে লিক’ প্রকাশ করে তারা বিচার প্রক্রিয়ার বাইরের হস্তক্ষেপ এবং বিচারিক অনিয়মগুলো উন্মোচন করে দিয়েছিল।
  • ক্ষমতাসীনদের লুটপাটের কাহিনি প্রকাশ : শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয় ও শেখ পরিবারের ব্যাপক লুটপাট এবং দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশ করেছিল। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক কেলেঙ্কারি জনগণের সামনে এসেছিল।

আমার দেশ দেখিয়েছে, জনগণের স্বার্থরক্ষায় তারা আপসহীন। এই আপসহীনতাই তাদের জনগণের প্রকৃত কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শক্তিধর মহলকে ভয় পেতে বাধ্য করেছে। এই অন্ধকার সময়েও ‘আমার দেশ’ ছিল একটি ব্যতিক্রম। এটা শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটা একটি প্রতিরোধের নাম। এ কারণেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি এই পত্রিকাটিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেত। তাদের ভয় ছিল এতটাই যে, বাংলাদেশে প্রকাশ বন্ধ হওয়ার পরও যখন ২০২০ সালে ইউকে থেকে অনলাইনে এটি আবার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বশক্তি নিয়ে তা বন্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ‘আমার দেশ’ পত্রিকা জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়, সম্পাদককে কারাবন্দি করা হয় এবং সাংবাদিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান নির্বাসন গ্রহণ করেন, তবে হাল ছাড়েননি। তারা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাস থেকেই আবার অনলাইনে ‘আমার দেশ’ চালু করেন। আমি নিজেও এই টিমের সঙ্গে যুক্ত হই ডেপুটি এডিটর হিসেবে। পত্রিকাটি আবার চালু হতেই দেশ থেকে পাঠকের প্রবেশাধিকার ব্লক করে দেওয়া হয়, যাতে বাংলাদেশের মানুষ পত্রিকাটি পড়তে না পারে। শুধু তাই নয়, ঢাকার মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে শত শত সাইবার আক্রমণ চালানো হয় এবং ভুয়া কপিরাইট ক্লেইম করে বন্ধ করার চেষ্টা চলে। এই প্রবল আক্রমণের মুখে মাত্র চার মাসের মধ্যেই ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ‘আমার দেশ’ আবার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা দমে যাইনি। ২০২২ সালের মার্চে আমরা আবার চালু করি, আক্রমণ চলে, কিন্তু আমরা থামিনি। অবশেষে, ২০২৫ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যখন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটায়, তখন ‘আমার দেশ’ বিজয়ী বেশে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসে।

একটি সংবাদমাধ্যমের সংগ্রামের এই ইতিহাস যেকোনো গণমাধ্যমের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। বিপ্লব-পরবর্তী দেশ গঠনে ও নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের সঠিক ভূমিকা নিরূপণে এটি হতে পারে অন্যতম পাথেয়।

৫ আগস্টের বিপ্লব আমাদের বিভক্তি-বিদ্বেষ-হানাহানি দূর করে সত্য, সাহস, সেবা আর সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি নির্মাণ করার সুযোগ দিয়েছে। এ সময় গণমাধ্যমের দায়িত্ব দ্বিগুণ। তাদের অবশ্যই ভালো কাজকে উৎসাহ দিতে হবে; যেমন, ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমর্থন জানানো। অন্যদিকে, পুরোনো ফ্যাসিবাদী প্রবৃত্তি যদি কোনো নতুন ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে দেখা যায়, তবে তাকে অবিলম্বে জনসমক্ষে নিয়ে আসতে হবে।

আসলে, এই দ্বৈত দায়িত্ব পালনে ধর্মীয় অনুশাসনও গণমাধ্যমকে পথ দেখায়। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ : ‘তা’মুরুনা বিল মা’রুফি ওয়া তানহাওনা আনিল মুনকার’—অর্থাৎ ‘তোমরা সৎকাজে আদেশ করো এবং অসৎকাজে নিষেধ করো। (সুরা আল-ইমরান, ১১০) একই সঙ্গে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে কঠোর সত্যনিষ্ঠা দাবি করে হাদিস : ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (যাচাই না করেই) তা প্রচার করে।’ (সহিহ মুসলিম) এই মূলনীতিগুলো মেনে চললে বিপ্লব-পরবর্তী মানুষের প্রত্যাশিত নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব হবে।

সাংবাদিক সমাজকে মনে রাখতে হবে, এ সময় তাদের কলমই পারে জাতীয় বিবেককে জাগিয়ে তুলতে। যদি অধিকাংশ মিডিয়া তাদের পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ করে, ‘আমার দেশ’-এর মতো সাহস ও আপসহীনতা নিয়ে জনগণের পক্ষে দাঁড়ায়, তবেই বাংলাদেশ সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

সাংবাদিকতার মুক্তিই গণতন্ত্রের মুক্তি এবং এই মুক্তিই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করবে। এই দায়িত্ব দীর্ঘ ও কঠিন, কিন্তু এটিই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকে একমাত্র অনিবার্য পথচলা। এই যাত্রাপথে জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে : সবাইকে মিলে সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়াতে হবে এবং ‘বাইজি’ সাংবাদিকতাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

লেখক : অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী একাডেমিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকারকর্মী ও এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর, সাউথ এশিয়ান পলিসি ইনিশিয়েটিভ)

গণমাধ্যমের বয়ান নির্মাণ এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বৈশ্বিক বয়ান ও হাসিনার ‘ডার্ক ডকট্রিন’

গণমাধ্যম কমিশনের রিপোর্টে আমার দেশ

‘কাকুতি মিনতি’ যুগের অপসাংবাদিকতার ছাপ

জাতিসংঘ অধিবেশন : হাসিনার কাগুজে হুংকার

টেলিভিশনের টকশো : সাংবাদিকতার মৃত্যু-পর্ব

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনি

গণমাধ্যম কর্মীদের যে পাঁচটি জিনিস জানা জরুরি

শিরস্ত্রাণবিহীন, উন্নত শিরঃ বীরোচিত গণমাধ্যম

যেভাবে জনতার সংবাদপত্র হয়ে উঠল আমার দেশ