হোম > মতামত

বামপন্থা ও স্বৈরাচার

ড. হাসান মাহমুদ

ড. হাসান মাহমুদ

বাংলাদেশে বামপন্থা ঐতিহাসিকভাবে গণতন্ত্র, শ্রমিক অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমতা বাম ধারার রাজনীতিকে নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই আন্দোলনের ভেতরেও অনেক সময় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, আদর্শগত কঠোরতা এবং অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত দমনের প্রবণতা বিদ্যমান। এই দ্বিমুখিতা—‘মুক্তির রাজনীতি’র ভেতরে ‘স্বৈরাচারের সংস্কৃতি’—বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম আত্মবিরোধী দিক।

কনওয়ে, হাউক, গর্নিক ও রেপকে (২০২১) তাদের গবেষণায় এই ধরনের বৈপরীত্যকে ‘Left-Wing Authoritarianism (LWA)’ ধারণার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে, স্বৈরাচারবাদ শুধু ডানপন্থি বৈশিষ্ট্য নয়; এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক গঠন, যা বাম ও ডান উভয় ধারায়ই প্রকাশ পেতে পারে—পার্থক্য শুধু রাজনৈতিক অভিমুখে।

Left-Wing Authoritarianism প্রকাশ পায় তিনটি মৌলিক মাত্রায়—

কর্তৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্য Authoritarian Submission, বিরোধীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক আচরণ Authoritarian Aggression এবং আদর্শগত শুদ্ধতার অনুশাসন ও সামাজিক চাপ Conventionalism ।

বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারকে এই তিন মাত্রায় বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কীভাবে ‘প্রগতির নৈতিকতা’র আড়ালে ‘নিয়ন্ত্রণ ও আনুগত্যের রাজনীতি’ গড়ে ওঠে।

বেশির ভাগ বামপন্থি দল—বিশেষত ছোট ছোট মার্কসবাদী, সমাজতান্ত্রিক বা ছাত্র সংগঠনগুলো—অত্যন্ত কেন্দ্রীয়ভিত্তিক (centralized) কাঠামোতে পরিচালিত হয়, যেখানে নেতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

এই কাঠামো অনেক সময় ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণ’ নামে লেনিনবাদী নীতি অনুসরণ করে; কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে দাঁড়ায় শুধু ‘কেন্দ্রীকৃত আনুগত্য’।

উদাহরণ :

ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট বা অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনে প্রায়ই নেতৃত্ব নির্বাচন হয় না, বরং কেন্দ্রীয়ভাবে ‘মনোনয়ন’ দেওয়া হয়।

  • নেতৃত্বের সমালোচনা করলে ‘বিপথগামী’, ‘সংশোধনবাদী’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত করা হয়।

এই ধরনের অনুশাসন কনওয়ে প্রমুখের ‘authoritarian submission’-এর সঙ্গে সরাসরি মিলে যায়—

যেখানে ব্যক্তি স্বাধীন চিন্তার বদলে ‘নেতৃত্ব ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য’-ই নৈতিক কর্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে দেখা যায়, অনেক তরুণ কর্মী রাজনীতিতে যোগ দেয় ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা থেকে; কিন্তু সংগঠনের কাঠামো দ্রুত তাদের শেখায়—‘প্রশ্ন করো না, পালন করো।’ এভাবে স্বাধীন চিন্তা থেকে দলীয় আনুগত্যে রূপান্তর ঘটে। এটি বাম রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক চর্চার বদলে কমান্ডচালিত শৃঙ্খলায় রূপ দেয়।

আদর্শগত শুদ্ধতার নামে বিরোধী মতের দমন

বাম সংগঠনগুলোয় আদর্শগত শুদ্ধতা (ideological purity) রক্ষার এক ধরনের কঠোর সংস্কৃতি প্রচলিত। যেকোনো ভিন্ন ব্যাখ্যা বা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোজনকে ‘আদর্শচ্যুতি’ হিসেবে দেখা হয়।

উদাহরণ—

  • ‘পুঁজিবাদী প্রভাব’ বা ‘বুর্জোয়া চিন্তা’র অভিযোগে কর্মীদের বহিষ্কার।
  • স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কাজ করলে সামাজিক বা সাংগঠনিক বয়কট।

এটি কনওয়ের তৃতীয় মাত্রার সঙ্গে মিলে যায়—conventionalism, অর্থাৎ ‘শুদ্ধ আদর্শ’ অনুসরণে বাধ্যবাধকতা ও সামাজিক চাপ।

বাংলাদেশে বামপন্থিরা নিজেদের প্রগতির একমাত্র বৈধ ধারক মনে করে—এই নৈতিক কর্তৃত্ববোধই তাদের অনেক সময় আলোচনার বদলে আদেশের রাজনীতিতে ঠেলে দেয়।

উদাহরণস্বরূপ, কিছু বাম সংগঠনে নারীবাদ বা পরিবেশবাদ নিয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ এলে সেটিকে ‘আদর্শচ্যুতি’ বলা হয়, যদিও সেটি সমাজতান্ত্রিক চিন্তার পরিপূরক হতে পারত।

এভাবে আদর্শগত শুদ্ধতা বাম রাজনীতিকে বহুমাত্রিকতার বদলে সেক্টরিয়ান সংকীর্ণতায় পরিণত করে।

ছাত্ররাজনীতিতে সহিংস ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ

বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ঐতিহাসিকভাবে ত্যাগী ও আদর্শবাদী হলেও, বাস্তবে দেখা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন দমন, ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ সহিংসতা।

উদাহরণ—

  • ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের বিভক্ত গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ।
  • নেতৃত্বের বিরোধিতাকারী ছাত্রদের ‘অবিশ্বাসযোগ্য’ বা ‘বহিষ্কৃত’ ঘোষণা।
  • সংগঠনের ভেতর ‘আলোচনার সংস্কৃতি’র বদলে ‘কমান্ডের সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠা।

কনওয়ে প্রমুখের তত্ত্ব অনুযায়ী, এই ধরনের আচরণ authoritarian aggression-এর উদাহরণ, যেখানে প্রতিপক্ষ বা সমালোচককে ‘আদর্শের শত্রু’ হিসেবে দেখা হয়।

রাজনৈতিক বাম কাঠামোর বাইরে, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা কনওয়ের ‘conventionalism’ ও ‘aggression’-এর মিশ্র রূপ।

মতাদর্শিক একরৈখিকতা

সাংস্কৃতিক বাম মহলে প্রায়ই ‘প্রগতিশীলতা’র একচেটিয়া সংজ্ঞা তৈরি হয়।

যেকোনো ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী বা বিকল্প চিন্তাকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে বাতিল করা হয়।

উদাহরণ—

  • সাহিত্য সমালোচনায় ধর্মীয় ভাবনানির্ভর লেখাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ বা ‘অপ্রগতিশীল’ বলে অবমূল্যায়ন।
  • চলচ্চিত্র বা নাটকে ‘জাতীয়তাবাদ’ বা ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ থাকলে সেটি ‘ডানপন্থি প্রভাবিত’ বলে প্রত্যাখ্যান।
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাম কর্মীরা নিজেদের বৃত্তের বাইরে মতপ্রকাশকারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা বয়কট করে।

এই একরৈখিকতা কনওয়ে প্রমুখের তৃতীয় মাত্রা—আদর্শগত শুদ্ধতার নৈতিক চাপের প্রতিফলন।

সংস্কৃতিতে বাম একচেটিয়াত্ব

১৯৮০-৯০-এর দশকে নাট্যচর্চা, গণসংগীত এবং সাহিত্য আন্দোলনে বামপন্থিদের নেতৃত্ব সমাজে নতুন আলো ছড়িয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনগুলো নিজস্ব বৃত্তে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

আজও কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন বা একাডেমিক গোষ্ঠী এমনভাবে আচরণ করে যেন ‘প্রগতিশীলতা’ একমাত্র তাদেরই সম্পত্তি। ফলে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে নৈতিক আধিপত্যের ক্ষেত্র, মুক্ত বিতর্কের নয়। এটি কনওয়ে প্রমুখের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘সামাজিকভাবে বৈধ স্বৈরাচার’, যা নৈতিকতার ছদ্মাবরণে মতের নিয়ন্ত্রণ ঘটায়।

রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থায় ক্ষমতানির্ভরতা

বাংলাদেশের বাম রাজনীতির আরেকটি রূপ হলো রাষ্ট্রীয় বামপন্থা, যেখানে দলীয় আদর্শ ধীরে ধীরে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আপস করে। ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, গণতান্ত্রিক বাম ফ্রন্ট ইত্যাদি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে, কিন্তু এর ফলে তারা প্রায়ই সমালোচনাহীন সহযোগীতে পরিণত হয়েছে।

উদাহরণ—

  • ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ (ইনু) ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের নীতির সমালোচনা থেকে দূরে গিয়ে বরং সরকারের সহযোগী হয়ে দাঁড়ায়, যদিও শ্রমিক অধিকার বা বৈষম্য বিষয়ে তাদের ঐতিহাসিক অবস্থান ভিন্ন ছিল।
  • দলীয় নেতাদের সমালোচনা রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ হিসেবে গণ্য হওয়ায়, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের স্থান ক্রমে সংকুচিত হয়।

এটি কনওয়ের authoritarian submission-এর একটি রাজনৈতিক সংস্করণ—যেখানে দলীয় আনুগত্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে মিলেমিশে যায় এবং বাম রাজনীতি তার স্বাধীন সমালোচনাশক্তি হারায়।

বামপন্থি স্বৈরাচারবাদের সামাজিক প্রতিফলন

এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের ফলে সমাজে এক ধরনের নৈতিক শ্রেণিবিন্যাস গড়ে ওঠে—‘প্রগতিশীল’ মানে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ, ‘অপ্রগতিশীল’ মানে পশ্চাৎপদ বা প্রতিক্রিয়াশীল।

উদাহরণ—

  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম কর্মীদের দ্বারা ‘ধর্মীয়’, ‘রক্ষণশীল’, বা ‘জাতীয়তাবাদী’ ছাত্রদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা।
  • ভিন্ন মতের বুদ্ধিজীবীদের আমন্ত্রণ না দেওয়া বা গবেষণায় অংশগ্রহণ থেকে বাদ রাখা।

এই প্রক্রিয়া কনওয়ের গবেষণায় বর্ণিত ‘moral absolutism’—অর্থাৎ নৈতিক সত্যের একচেটিয়া দখলের উদাহরণ। ফলে বাম রাজনীতি মানুষকে সংগঠিত করার বদলে বিচ্ছিন্ন করে, কারণ এটি ‘নৈতিক উচ্চতরতার রাজনীতি’তে পরিণত হয়।

কনওয়ে প্রমুখ দেখান যে Left-Wing Authoritarianism-এর মূল চালিকাশক্তি হলো এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা—নিশ্চয়তা, নৈতিক অখণ্ডতা ও শৃঙ্খলার আকাঙ্ক্ষা।

বাংলাদেশের বামপন্থিদের মধ্যেও এই মানসিকতা দেখা যায় : তারা মনে করেন, তাদের আদর্শই একমাত্র মানবমুক্তির পথ, তাই ভিন্নমত বিপজ্জনক।

এই মানসিক কাঠামোই বাম রাজনীতিকে অগণতান্ত্রিক করে তোলে। ফলে সমালোচনা মানে হয়ে যায় শত্রুতা এবং আত্মসমালোচনা দুর্বলতা।

তবে সব বামধারা এমন নয়। বর্তমান প্রজন্মের অনেক নাগরিক সংগঠন—যেমন : শ্রমিক-নারী-পরিবেশ আন্দোলনের নতুন প্ল্যাটফর্মগুলো—বিকেন্দ্রীভূত, অংশগ্রহণমূলক ও সংলাপনির্ভর রাজনীতি চর্চা করছে। হয়তো এই ধারা থেকেই বাংলাদেশের বাম রাজনীতির পুনর্জন্মের সম্ভাবনা দেখা যেতে পারে—যেখানে কর্তৃত্ব নয়, সহযোগিতা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও একে ওপরের থেকে শেখাই হবে প্রধান মূল্যবোধ।

আত্মসমালোচনা ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ

কনওয়ে প্রমুখের গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—স্বৈরাচার শুধু রক্ষণশীলদের সমস্যা নয়; এটি মানবচেতনার গভীরে থাকা কর্তৃত্ব-আকাঙ্ক্ষা।

বাংলাদেশের বাম রাজনীতিও সেই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে নয়।

তারা সমতার রাজনীতি করতে গিয়ে যখন নৈতিক একচ্ছত্র কর্তৃত্বের রাজনীতিতে চলে যায়, তখন প্রগতিশীলতার প্রকৃত শক্তি—সমালোচনামূলক চিন্তা, মুক্ত বিতর্ক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ—ক্ষীণ হয়ে পড়ে।

বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই আত্মসমালোচনার ওপর : তারা কি ‘সঠিক আদর্শ’র নৈতিক আত্মম্ভরিতা ভেঙে মুক্ত, সহনশীল ও চিন্তাশীল বামপন্থার দিকে ফিরতে পারবে? যদি পারে, তাহলে বাম রাজনীতি আবার জনজীবনের ন্যায়বিচার ও মানবমুক্তির সম্ভাবনা ফিরিয়ে আনবে—না পারলে, তা শুধু অন্যরকম স্বৈরাচার হিসেবেই টিকে থাকবে, নৈতিকতার রঙে রাঙানো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়ের্স্টান বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)

পাহাড়ে নতুন ষড়যন্ত্র

বিনোদনের বিপ্লব ও জেন-জি সংস্কৃতি

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের দ্বিধা

ভোট কারচুপি রোধে প্রয়োজন সিসি ক্যামেরা

দুর্নীতির মহানগর থেকে ট্রিলিয়ন ডলারের স্বপ্নযাত্রা

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

রাজনীতিতে শেষ কথা ও রাজনীতিবিদদের সততা

হাসিনার রায় : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও আঞ্চলিক পরিণতি