হোম > জাতীয়

ফয়সালের ব্যাংক হিসাবে রহস্যজনক লেনদেন

ওয়াসিম সিদ্দিকী

জুলাই বিপ্লবী শরীফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ও জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের এই মুখপাত্রের ওপর হামলার ঘটনায় আততায়ী হিসেবে যার নাম উঠে এসেছে, তিনি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডার ফয়সাল করিম মাসুদ (ছদ্মনাম-দাউদ বিন ফয়সাল)। তাকে ঘিরে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। তার রাজনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের তথ্যও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

জানা গেছে, ফয়সাল ছাত্ররাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি সর্বশেষ ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এবং আদাবর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জুলাই বিপ্লবের পর নিষিদ্ধ সংগঠনটির পক্ষে ঝটিকা মিছিল, চোরাগোপ্তা হামলা ও বৈঠকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। এমনকি ভারতে পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ফয়সালের রাজনৈতিক উত্থান ছিল দ্রুত। স্থানীয় পর্যায়ে তিনি শুধু পদধারী নেতা নন, বরং প্রভাব বিস্তারে দক্ষ সংগঠক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার এই প্রভাবের পেছনে ছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার আশীর্বাদ। বিশেষ করে ফ্যাসিবাদী দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বর্তমানে ভারতে পলাতক কামালের অত্যন্ত বিশ্বস্ত অনুসারী ছিলেন ফয়সাল।

এই প্রভাবশালী নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতাই তাকে ক্ষমতার বৃত্তে অবস্থান করতে সাহায্য করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুতর তথ্য হলো, গুলিবর্ষণের মাত্র কয়েক দিন আগে, গত ৯ ডিসেম্বর একটি কালচারাল বৈঠকে ফয়সালকে হাদির ঠিক পাশেই বসে থাকতে দেখা যায়। হামলাকারী হিসেবে সন্দেহে থাকা ওই ব্যক্তি হাদির ঘনিষ্ঠ হওয়ারও চেষ্টা করেন। ‘মানবতাবাদী মুক্ত চিন্তার অধিকারী’ জুলাই বিপ্লবী হাদির উদারতার সুযোগ নিয়ে হামলার বিষয়ে পূর্ব ধারণা বা প্রস্তুতি নিতেই হাদির আশপাশে ভিড়েছিলেন আততায়ী ফয়সাল।

সন্দেহজনক আর্থিক সাম্রাজ্য

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, হাদির ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলোর একটি হলোÑজুলাই বিপ্লবের পর ফয়সালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল অঙ্কের লেনদেন। একাধিক ব্যাংকে থাকা তার হিসাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বল্প সময়ে বড় অঙ্কের টাকা জমা ও উত্তোলন হয়েছে। এই লেনদেনের একটি অংশ এসেছে বিদেশ থেকে। তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন, এসব অর্থ বৈধ চ্যানেলে এসেছে কি না। একই সঙ্গে দেশের ভেতর থেকেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তার অ্যাকাউন্টে অর্থ এসেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, কারা এই অর্থ দিয়েছেন এবং কী উদ্দেশ্যে দিয়েছেনÑতা জানাই এখন তদন্তের অন্যতম লক্ষ্য। বিদেশে অবস্থানরত কিছু ব্যক্তির সঙ্গে ফয়সালের নিয়মিত আর্থিক যোগাযোগের তথ্যও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতে পলাতক কামালের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার তথ্য বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।

সূত্র বলছে, রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক লেনদেনের এই যোগসূত্র হামলার পেছনের পরিকল্পনা বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ফয়সালকে দ্রুত গ্রেপ্তারের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ৫০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ফয়সালের বিরুদ্ধে আগেও গুরুতর অপরাধের অভিযোগ ছিল, যা তার বর্তমান কর্মকাণ্ডকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে। ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আদাবর থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়।

গ্রেপ্তারের পর দ্রুততার সঙ্গে তার পক্ষে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করা হয়। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে। তবে এই জামিন প্রক্রিয়া নিয়ে আইন অঙ্গনে প্রশ্ন ওঠে যখন দেখা যায়, জামিন আদেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ১৯ ফেব্রুয়ারি আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পায়। পরে ১২ আগস্ট হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ তার জামিনের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বাড়িয়ে দেয়।

অস্ত্র মামলার আসামি, যিনি জামিনে থাকাকালীন সময়েই সম্ভাব্য একজন প্রার্থীর ওপর এমন ভয়াবহ হামলার প্রধান সন্দেহভাজন হলেন, সেই প্রক্রিয়া এখন আইনের শাসন নিয়ে জনমনে গভীর সংশয় তৈরি করেছে। তদন্তকারীরা ফয়সালের জামিনকালীন চলাফেরা ও যোগাযোগগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখছেন।

রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় পরিবার

ফয়সালের রাজনৈতিক সংযোগ শুধু তার ব্যক্তিগত পরিচয়েই সীমাবদ্ধ নয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তার পরিবারও আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত। যদিও তার বাবা একজন ছোট ব্যবসায়ী, তবে পরিবারের এই দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তাকে এবং পরিবারকে মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রভাব বিস্তারে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। হামলার ঘটনার পর পরিবারের দুই সদস্যকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

ফয়সাল তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশ দক্ষ। সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি গুলি করার আগেই তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভ করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হাদিকে গুলি করা হয়। ঘটনার দিন আততায়ী ফয়সাল মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেনি। এমনকি তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আশপাশে কিলার গ্রুপের রেসকিউ টিমও ছিল।

আইটি ফার্মের মালিক ফয়সাল

ফয়সাল ‘অ্যাপল সফট আইটি’ নামে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি দুবছর আগে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসেরও (বেসিস) সদস্য হন। বেসিসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অ্যাপল সফট আইটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি। এটি আদাবর এলাকায় অবস্থিত। এর মাধ্যমে দেশের আইসিটি খাতে দক্ষ কর্মী তৈরি এবং প্রশিক্ষণের কাজ করা হয়। কোম্পানির সেবার মধ্যে আরো আছেÑ ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট, প্রশিক্ষণ, আউটসোর্সিং ট্রেনিং, সার্টিফাইড প্রফেশনাল ইন ট্রেনিং ম্যানেজমেন্ট, এসকিউএল ডাটাবেস পরিচালনা, গেম ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক্স ও লোগো ডিজাইন, ২ডি-৩ডি অ্যানিমেশন, অ্যানিমেশন কার্টুন ডেভেলপমেন্ট, বিজ্ঞাপন তৈরি এবং অন্যান্য ডিজিটাল সমাধান।

হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করে বেসিসের এক সদস্য আমার দেশকে বলেন, এইট পিয়ারস সলুশনস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শাহজালালের সুপারিশে ফয়সালকে বেসিসের সদস্য পদ দেওয়া হয়। ফয়সাল ২০২০ সালের ৯ জুন বেসিসের সদস্য হন।

এসব তথ্যের মাধ্যমে সন্দেহভাজন হামলাকারীর পরিচয় এবং তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সংযোগও আলোচনায় এসেছে। তবে শাহজালাল আমার দেশকে বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। ফয়সালকে চেনেনও না।

হাদির ওপর সশস্ত্র হামলা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; এটি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি পরিবেশ ও নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘আমরা প্রাইম সাসপেক্টকে খুঁজছি। হোপফুলি আমরা হিট করতে পারব। আমরা জনগণের সহযোগিতা চাইছি।’

হাদিকে গুলি: মির্জা আব্বাসকে নিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করায় মামলা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পরিকল্পিত নীলনকশা

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্রের অংশ

আমরা রক্ত দেবো কিন্তু জুলাই দেবো না: সাইফুল আলম

দেশকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে: সাইফুল হক

গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে চিহ্নিত করা যাচ্ছেনা, বিশ্বাসযোগ্য নয়

জনগণের সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি হামিদুর রহমানের

সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই

বুলেট দিয়ে মুক্তির লড়াই বন্ধ করা যায় না : ব্যারিস্টার ফুয়াদ

একাত্তরে পাকিস্তান পরবর্তীতে হিন্দুস্তান বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠরোধ করেছে