স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে পরিবারকে বিপদে রেখেই দেশের জন্যে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রণাঙ্গনে সন্মুখভাগে লড়াই করেছেন সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর হাতে দুই সন্তান নিয়ে দুঃসহ বন্দীজীবন কাটিয়েছেন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া। সাদামাট গৃহবধূ হিসেবেই জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েও নিজের ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়চেতা বৈশিষ্ট্যের কারণে এক সময় উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন বেগম খালেদা জিয়া।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে ৩০ মে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে শাহাদাৎ রবণ করেন। আধিপত্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক কতিপয় বিপদগামী সেনা সদস্যের ব্রাশফায়ারে শহীদ হওয়ার পর বিএনপির হাল ধরতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা রাখেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তিনি।
১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়াপারসন নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। সেই থেকে আমৃত্যু তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের মঈন উদ্দীন ও ফখরুদ্দীন সরকারের সময় দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিম্ন আদালতে পাঁচ বছরের সাজা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় পুরোনো ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে তাকে রাখা হয়। এরপর ওই বছরের ১ এপ্রিল তাকে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। পরবর্তী সময়ে নিম্ন আদালতের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
সংগ্রাম মুখর জীবনের এক প্রায় এক দশকের মাথায় খালেদা জিয়া ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরমধ্যে দ্বিতীয়দফার দায়িত্বকাল ছিল একমাস। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব। সকল পূর্বাভাস ভুল প্রমান করে দলকে জয়ী করতে সমর্থ হন খালেদা জিয়া। নিজেও পাঁচ পাঁচটি আসনে রেকর্ড ভোটে বিজয়ী হন। ওই বছরই পঞ্চম সংসদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হন। তার নেতৃত্বেই সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারপদ্ধতি থেকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর এক মাসের জন্য ষষ্ঠ সংসদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রণয়নের পর ওই বছরে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে যায় খালেদা জিয়ার দল বিএনপি; তিনি হন বিরোধীদলীয় নেতা।
১৯৯৯ সালে অধ্যাপক গোলাম আজমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে গঠিত চারদলীয় ঐক্যজোটের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ফের বিরোধীদলীয় নেতা হন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেন তিনি। একইসঙ্গে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সে বছর নির্বাচন থেকে বিরত থাকে। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় খালেদা জিয়া যখন কারাগারে, তখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের মধ্যে সমন্বয় করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে থাকায় সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি খালেদা জিয়া। এমনকি, এই নির্বাচনে জিয়া পরিবারের কোনও সদস্যই অংশগ্রহণ করেননি।