সেমিনারে আখতার হোসেন
দুটো বড় রাজনৈতিক দল কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম আর গণভোটকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন৷ শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মিলনায়তনে 'তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা: জাতীয় অর্থনীতির নতুন শক্তি' শীর্ষক সেমিনারে দেওয়া বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি। জাতীয় কৃষি দিবস উপলক্ষে এনসিপির কৃষিবিদ উইং এই সেমিনারের আয়োজন করে৷
আখতার হোসেন বলেন, 'দুইটা বড় দল কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম এবং সংস্কারের জন্য গণভোটকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একটি দল কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম চাওয়ার কথা বলে জনগণের প্রত্যাশিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যে সংস্কার সেটাকে গৌণ করে ফেলছে। আবার আরেকটি দল আলু না গণভোট স্লোগানের মধ্য দিয়ে আলুর যে ন্যায্য দাম অর্থাৎ কৃষিপণের ন্যায্য দাম যে কৃষকেরা পাচ্ছেন না সেটাকে গৌণ করে ফেলছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কৃষিপণের ন্যায্য দাম এবং সংস্কারের জন্য গণভোট দুইটাই একই সঙ্গে সমান্তরালে গুরুত্বপূর্ণ।'
এনসিপির এই নেতা বলেন, আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি আমরা বিশ্বাস করি এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রকে আমরা যদি সংস্কার করতে না পারি তাহলে আমরা কৃষকের ন্যায্য মূল্য অর্জন করতে পারবো না। যদি এই বাংলাদেশটা এক ব্যক্তির কাছে একটা দলের কবজায় থেকে যায় এবং পুরনো সমস্ত কলকবজা পুরনো সমস্ত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে টিকে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের কোন মানুষের মুক্তি সম্ভব না। কৃষকের মুক্তি সম্ভব না। কৃষকের মুক্তির জন্যই, এদেশের জনতার মুক্তির জন্যই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সংস্কার অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমরা সংস্কারকে এবং কৃষকের চাহিদাকে, ন্যায্যতাকে আমরা পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে দেখতে পারি না।
আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগীরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করেন আখতার৷ তিনি বলেন, যে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল সেটা গুটিকয়েক আওয়ামী নেতার উন্নয়ন ব্যতিরেকে জনগণের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। সেই ফ্যাসিবাদী আমলের বাংলাদেশ সামনের দিনে আমরা আর প্রত্যাশা করি না। আমরা সামনের দিনে এমন একটা বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি যেই বাংলাদেশে রাজনীতি, মারামারি, কাটাকাটি, হট্টগোলের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হবে না।
জুলাই সনদের বিষয়ে আখতার হোসেন বলেন, আমরা বিশ্বাস করি মারামারি কাটাকাটি হানাহারির যে সংস্কৃতি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা একটা পলিসি নির্ভর বাংলাদেশ গঠন করতে পারব। জুলাই সনদের বিষয় নিয়ে অনেকগুলো দল যে ধোয়াসার জায়গা তৈরি করছেন সেটাকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। আমরা ঐকমত্য কমিশনে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ, গণভোট এবং পরবর্তী সংসদকে দীত্ব (উনি দীত্ব বলেছেন, কিন্তু শব্দটা সম্ভবত দ্বৈত) ক্ষমতা প্রদানের মধ্য দিয়ে সংবিধানের মৌলিক সংস্কারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আমরা মোটা দাগে একমত হয়েছি। কিন্তু ইদানিং একটি দলের নেতারা চূড়ান্তভাবে গণভোটের রায়কে প্ৰত্যাখ্যান করার মতামত ব্যক্ত করছেন। তারা গণভোটে না ভোট দেওয়ার জন্য ক্যাম্পেইন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা সে ক্যাম্পেইন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তারপরেও এখনো পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা দেখাবেন সে ধরনের কোন মতিগতি আমরা সেই রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রত্যক্ষ করছি না।
আমরা স্পষ্টভাবেঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান জানাতে চাই জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধান সংস্কার যে আদেশ জারি করা হয়েছে অনেকগুলো জায়গাতে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে, সংস্কারকে ভাগ করে ফেলা হয়েছে, সরকারের মর্জিমতো। এবং সংস্কারের বিষয়বস্তুগুলোকে রাজনৈতিক দলের আওতাধীন করে ফেলা হয়েছে, তাদের মতিগতির ওপরে তাদের অভিরুচির উপরে। এমন অস্পষ্ট অবস্থায় রেখে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
জুলাই সনদের অস্পষ্টতা দূর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান আখতার। তিনি বলেন, 'আমরা সরকারের কাছে আহ্বান রাখবো সরকার অতিদ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের যে আদেশ তার অস্পষ্টতাগুলো দূরীকরণ করবে। এবং রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের রায়কে মেনে নিয়ে এই বাংলাদেশে যেন শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে রাস্তায় সকলে মিলে হাঁটবে কোন বিঘ্ন তৈরি করবে না।'
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়, কারণ এ দেশের সামাজিক আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে ব্রিটিশদের দ্বারা। কৃষককে সংসদে নিয়ে যেতে হবে বলে উল্লেখ করেন সামান্তা। তিনি বলেন, কৃষিকে আলাদা খাত হিসেবে বিবেচনা না করে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। এনসিপি চায় একজন কৃষক যেন সংসদে যেতে পারে। নিজের অধিকারের কথা নিজেই বলতে পারে। কৃষিকে আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে পারলেই কৃষিবিপ্লব হবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, দুর্নীতিতে কমিশনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে এতদিন দেশে কৃষিবিপ্লব সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন হান্নান।
তিনি বলেন, 'আমাদের অর্থনীতিকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে আমাদের অর্থনীতিই টিকবে না। আমরা এমন অর্থনীতি কেন গড়ে তুললাম, যে অর্থনীতি পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করবে? সব সময় সবার সাথে কি আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে? এ কারণে তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন চাইবে সরকার পরিবর্তন করে দিতে পারবে। ভারত ওপর নির্ভরশীলতার কারণে ভারত দীর্ঘ ১৫ বছর শেখ হাদিনার মতো একজন ফ্যাসিস্টকে টিকিয়ে রেখেছে৷'
এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মহাম্মদ ইউনূসকে দেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে জানান হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, 'নতুনভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমরা নোবেলজয়ী ইকোনোমিস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আমরা ভাবছিলাম, তিনি উদ্যোগগুলো নেবেন। কিন্তু দেখা গিয়েছে, স্টাবলিশমেন্টের চাপে উনি নিজেই আত্মসমর্পণ করেছেন। এবং সে আগের ধারাবাহিকতার ওপর, আগের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর, আগের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর, আগের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর, আগের সামাজিক ব্যবস্থার ওপর আমাদের ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন। এবং তোমরা আবার লড়াই করো।'