বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলো।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি সুনির্দিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।
সেই সাক্ষাতের পরদিন বুধবার জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে কিছু উপদেষ্টার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি নেতারাও তাদের অভিযোগ জানিয়েছেন।
বিতর্কিত উপদেষ্টা কারা, কেন দলগুলো এমন অভিযোগ তুলছে-এসব প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা অনেক দিন ধরেই কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছেন।
তারা কখনো তাদের চোখে নিরপেক্ষ নয় বা বিতর্কিত, এমন উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করেননি। তাদের অভিযোগও অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়।
তবে দলগুলো প্রতিপক্ষ দলকে জড়িয়ে এই অভিযোগ তুলছে। বিএনপির অভিযোগ, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ দল বলতে তারা জামায়াতের দিকে ইঙ্গিত করছে।
জামায়াতও একইভাবে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করে আসছে।
বর্তমানে এনসিপির অভিযোগ বিএনপি ও জামায়াতকে টার্গেট করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর 'ভাগ-বাঁটোয়ারায়' উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রভাবশালী তিনটি দল কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের অভিযোগ এখন হাজির করেছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
গত দুই দিনে দল তিনটির নেতারা আলাদা আলাদাভাবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন। বিএনপি তাদের কাছে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টার নামও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির চোখে বিতর্কিত উপদেষ্টা কারা
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা গত মঙ্গলবার দেখা করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।
সেই বৈঠকে তারা কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। বিএনপির অভিযোগ, প্রশাসনে ও পুলিশে বদলি-পদায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে কাজ করছেন ওই উপদেষ্টারা।
প্রশাসনে রদবদল বা পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে চারজন উপদেষ্টা ও কেবিনেট বা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব রয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, ওই কেবিনেট কমিটি নিয়েই আপত্তি জানিয়েছেন তারা।
দলটির যে নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন, তাদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টার নাম তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন।
বিএনপির সেই বিতর্কিতদের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি প্রশাসনে রদবদলের কেবিনেট কমিটিতে রয়েছেন। এই কমিটির আরেকজন সদস্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব শেখ আব্দুর রশিদের নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধেও একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানিয়েছে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি খোদা বখস চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ওই মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার পরই মি. চৌধুরীর অবস্থান।
বিএনপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে খোদা বখস চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দিয়েছেন।
কোনো কোনো উপদেষ্টা রাজনীতি বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, এই অভিযোগও বিএনপি জানিয়েছে। এই অভিযোগের ক্ষেত্রে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের থাকা উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার দিকে আঙুল তুলেছে বিএনপি।
দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের যাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের ও কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তারা এনেছেন, তাদের যেন সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, এই আবেদনও তারা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
বিএনপি যাদের নাম দিয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে দলগুলোর প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে কয়েকদিন আগে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যেহেতু বড় সব দলই অভিযোগ করছে, ফলে সরকার ঠিক পথে আছে বলে তিনি মনে করেন।
কিছু উপদেষ্টার নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বিএনপি বলেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুডে বা আদলে কাজ করবে বলে তারা চাইছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ একটি গণমাধ্যমকে বলেন, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে কাজ করবে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সেই আবেদন জানিয়েছেন তারা।
সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাস মেয়াদের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল, সেই ব্যবস্থায় ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
২০০৮ সালেও নির্বাচন হয়েছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনে ক্ষামতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এক রিট মামলায় হাইকোর্ট আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করে। হাইকোর্ট আদেশের ওপর এখন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল আবেদনের শুনানি চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি এখন তত্ত্বাবধঅয়ক সরকারের আদলে কাজ করে, তাহলে এই সরকারকে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড বাদ দিতে হবে। সরকারকে শুধু নির্বাচন পরিচালনায় রুটিন কাজ করতে হবে।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হবে সংসদ নির্বাচন। সেকারণে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কাজ করবে, সেটাই তারা চান।
জামায়াত ও এনসিপি অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আনছে না। তারা বলছে, সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, সেটি তাদের প্রত্যাশা।
আর সেই প্রেক্ষাপটে এই দল দুটিও কিছু উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিতর্কিতদের নাম প্রকাশ করেনি জামায়াত
বিএনপির পর জামায়াতের নেতারা দেখা করেছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এই বৈঠকে জামায়াত নেতারা তাদের অভিযোগ তুলে ধরেন।
তাদেরও অভিযোগ মূলত প্রশাসনে রদবদল ও পদায়ন নিয়ে। আর এক্ষেত্রে জামায়াত নেতারা বলেছেন, কিছু উপদেষ্টা একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছেন। এই বিশেষ দল বলতে তাদের টার্গেট বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে জামায়াতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমি সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। তিনি সংবাদিকদের বলেছেন, তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একটি গণমাধ্যমকে বলেন, তারা তাদের অভিযোগের ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করলেন। প্রয়োজনে পরে তারা তাদের কাছে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নাম প্রকাশ করবেন।
তবে জামায়াতের অন্য একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন উপদেষ্টার ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ ওই জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। ফলে জামায়াতেরও নজর যে প্রশাসন ঘিরে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কলেবর নিয়ে চিন্তা ছিল এনসিপির
বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জনপ্রশাসনে বদলি-পদায়নে বড় দলগুলোর 'ভাগ-বাঁটোয়ারায়' উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সহায়তা করা হচ্ছে।
দলটির এমন বক্তব্য থেকে এটা বলা যায়, তারাও প্রধান উপদেষ্টার কাছে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেছে।
বিএনপি, জামায়াতের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এনসিপি নেতাদের এই সাক্ষাতের পেছনে ভিন্ন কারণ ছিল বলেও দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এই সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আর এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয় কি না, এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল।
মূলত এ উদ্বেগ নিয়েই তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন।
এনসিপির সূত্রগুলো জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সংখ্যা বা কলেবর বারুক কিংবা কমুক, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বেই নির্বাচন হবে, এ ব্যাপারে তাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই দুই দল নির্বাচন সামনে রেখে একে অপরকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দল দুটির মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস কাজ করছে।
সেকারণে তারা কিছু উপদেষ্টার আতীত রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত একে অপরকে জড়িয়ে কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলগুলোর বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে সরকার কাজ করবে।
তবে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারের প্রভাবশালী দলগুলোর নজর প্রশাসনে। তারা স্ব স্ব দলের পক্ষে প্রশাসনে ও পুলিশে তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে।
আর সেজন্য সরকার ও প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি বিভিন্ন অভিযোগ তুলছে বলে মি. আহমদ মনে করেন।
বিশ্লেষকেরা এ-ও বলছেন, দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তাদের মধ্যে আস্থার অভাব আরও বাড়াতে পারে এবং রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কাও থাকে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা