জালিয়াতি করে জাল সনদে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি নেয়ার অভিযোগে বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগের সেই নেত্রীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। গত রোববার কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির কার্যনির্বাহী সভায় তাকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করে বিদ্যালয়টির গভর্নিং বডি। এ কমিটির সভাপতি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন।
আফরোজা আক্তার ডিউ কুষ্টিয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লবের স্ত্রী।
বিদ্যালয় সূত্র জানায়, ডিউ ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে দারুল ইহসান নামে একটি কথিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য থেকে পাস করা অনার্স ও মাস্টার্সের সনদ দাখিল করেন। দীর্ঘদিন ধরে জাল সনদে চাকরিরত থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দিয়ে আসছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিউ আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে ঘটনাটি নজরে আসে কমিটির। জাল সনদে চাকরি নেওয়া ছাড়াও তার বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ লোপাট ও তছরুপের অভিযোগ উঠে।
এ প্রসঙ্গে কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ফিলিপনগর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সবুর।
লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে কুষ্টিয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এহতেশাম রেজা অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি ডিউয়ের নিয়োগকালে স্কুলে জমা দেওয়া সকল একাডেমিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাইকালে বেসরকারি দারুল ইহসান নামে (বর্তমানে ইউজিসি কর্তৃক কালো তালিকাভুক্ত ও হাইকোর্ট থেকে অবৈধ ঘোষিত) একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রির কাগজ খুঁজে পান। দারুল ইহসান নামের ওই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স সার্টিফিকেটের সিরিয়াল নম্বর-০৪৬৩৭ এবং মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের সিরিয়াল নম্বর-০০৩৯৮১। যাচাইকালে ইউজিসি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে দুটি সার্টিফিকেটই ভুয়া বা জাল।
ইউজিসির দেয়া তথ্যে ভুয়া বা জাল সার্টিফিকেটে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গত রোববার ম্যানেজিং কমিটির কার্যনির্বাহী সভায় তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার ও নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বেতন, ভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা নেওয়া সমুদয় অর্থ ফেরতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং কমিটির সভাপতি আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, সহকারী প্রধান শিক্ষক আফরোজা আক্তার ডিউ জাল বা ভুয়া সনদে চাকরিরত ছিলেন—বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে এই শিক্ষক যে বেতন, ভাতাসহ সুবিধা নিয়েছেন তা ফেরত দিতে তাকে নোটিশ করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না দিলে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ডিউ কুষ্টিয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয়ে এবং তার স্বামী কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফের সাথে সখ্যতার সুযোগে সরকারি সম্পদ লুটপাটসহ ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন এই দম্পতি। গত বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা গা ঢাকা দেন। এই দম্পতি ছাত্র জনতার ওপর হামলাসহ একাধিক হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
ডিউয়ের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সোহরাব আলী ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত (মৃত্যুকালীন পর্যন্ত) কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং তার মা শাহানারা বেগম ১৯৮৭ সালে কুষ্টিয়া জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। শাহানারা বেগম বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।
ডিউ ১৯৭৬ সালের ২ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ক্ষমতার প্রভাবে ২০১৬ সালে জয়ীতা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৩ সালে জাহানারা ইমাম তাকে কুষ্টিয়া জেলা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল ও সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য সচিব করে কুষ্টিয়া জেলা কমিটি ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড কুষ্টিয়া জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ উইমেন জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বিবর্তন’ এর কোষাধ্যক্ষ ও আলোর দিশা মহিলা সংস্থার সভাপতি, কুষ্টিয়া লেডিস ক্লাবের সাহিত্য ও প্রচার সম্পাদক, কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য, সরকারী শিশু সদন (বালিকা) এর ম্যানেজিং কমিটির সদস্য এবং কুষ্টিয়া জেলা রেফারি আম্পায়ার সমিতির আজীবন সদস্য, জেলা ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য, আবাহনী ক্রীড়া চক্রের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক সমিতি (বানাসাস) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক, সাংবাদিক ইউনিয়ন কুষ্টিয়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন পদও ভাগিয়ে নিয়েছিলেন এই নেত্রী।